?> বায় মুরাবাহা বিনিয়োগ পদ্ধতি - Best Information

বায় মুরাবাহা বিনিয়োগ পদ্ধতি

বায়মুরাবাহা বিনিয়োগ পদ্ধতি(Investment Method of bai Murabaha)

 

ইসলামী ব্যাংকিংয়ে মুরাবাহা একটি সাধারণ ও সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতি। শরী’আহসম্মত এই পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রীর আমদানি- রপ্তানি ও ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসায়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারে। ব্যাংক সাধারণত আগ্রহী ক্রেতার চাহিদামাফিক পণ্য ক্রয় করে তার সাথে একটা মুনাফা (মার্ক আপ Mark Up নামে সচরাচর পরিচিত) যুক্ত করে তার কাছেই এটা বিক্রয় করে। এ পদ্ধতি ইসলামী ব্যাংকসমূহে প্রচলিত এবং অনুশীলিত শীর্ষস্থানীয় প্রধান বিনিয়োগ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি। কোনো কোন ব্যাংকে এটি একমাত্র বিনিয়োগ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

 

বায়মুরাবাহার পরিচিতি(Introduction of Bai Murabah)

 

আরবি ‘রিবহন’  শব্দমূল থেকে মুরাবাহার (1) উৎপত্তি হয়েছে। ‘রিবহুন’ অর্থ লাভ। মুরাবাহা অর্থ নির্ধারিত লাভ। অর্থাৎ ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মতিক্রমে তথা সম্মত নির্ধারিত লাভে বিক্রয় করার নাম মুরাবাহা। কোনো পণ্যের ক্রয়মূল্যের ওপর ক্রেতা, বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিতে নির্ধারিত লাভে বিক্রয় করাকে বায়’ মুরাবাহা বলে। এ ক্ষেত্রে ক্রেতার কাছ থেকে নগদ মূল্য গ্রহণ করে পণ্য সরবরাহ দেওয়া যেতে পারে এবং ক্রেতাকে ভবিষ্যতের কোনো নির্ধারিত সময়ে বা নির্ধারিত কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করার সুযোগও দেওয়া যেতে পারে। এভাবে মুরাবাহা মূলত একটি ক্রয়- বিক্রয় পদ্ধতি

 

মাল ক্রয়ের পর ক্রয়মূল্যের সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ যুক্ত করে তা পুনরায় বিক্রয় করে মালের মালিকানা অন্যের নিকট হস্তান্তর করে দেওয়াকে বায়’ মুরাবাহা বলা হয়। প্রথম মূল্যের (ক্রয়মূল্যের) সাথে লাভ যুক্ত করে প্রথম চুক্তির মাধ্যমে অর্জিত মালিকানা হস্তান্তর করাকে বায়’ মুরাবাহা বলা হয়।

 

পারিভাষিক সংজ্ঞা

 

১. ‘সেন্ট্রাল শরী’আহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ’ কর্তৃক প্রণীত ও বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত (প্রস্তাবিত) ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন’ এ ‘বায়’ মুরাবাহা’-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “বায়’ মুরাবাহা’ বলতে এমন এক ব্যবসায়িক চুক্তিকে বুঝাবে, যার অধীনে ব্যাংক বিনিয়োগ গ্রাহকের অনুরোধে নির্ধারিত মালামাল ক্রয় করে ক্রয়মূল্যের সাথে উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত লাভ যুক্ত করে তার নিকট বিক্রয় করবে।” বিনিয়োগ গ্রাহক চুক্তির শর্তানুসারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করে মালামাল গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে। এ চুক্তিতে পণ্যের প্রকৃত ক্রয়মূল্য উল্লেখ করতে হবে।

 

২. ড. এম. উমর চাপরা-এর মতে, (Bai Murabaha in its simplest sense stands for supply of goods by the seller to the buyer at a specified profit margin mutually agreed between them) অর্থাৎ, “সাধারণভাবে বায়’ মুরাবাহা বলতে ক্রয়মূল্যের ওপর বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত মুনাফা, মার্জিন বা মার্ক আপ ধার্য করে বিক্রয় করাকে বুঝায়। ”

 

৩. ড. এম. এ. মান্নান-এর মতে, (Murabaha means resale of goods with the addition of a fixed surcharge to the stated original cost.) অর্থাৎ, “ক্রয়মূল্যের সাথে মুনাফার সংযুক্তিমূলক ব্যবসায়কে ‘মুরাবাহা’ বলে।”

 

৪. আব্দুর রকীব-এর মতে, “নগদে অথবা ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোনো সময়ে একসাথে অথবা নির্ধারিত কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের শর্তে বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ের সম্মতিক্রমে ক্রয়মূল্যের ওপর নির্ধারিত মুনাফা ধার্য করে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরী’আহ অনুমোদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করাকে বায়’ মুরাবাহা বলে।”২০৮

 

৫. মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানীর মতে, “মুরাবাহা এমন একটি পদ্ধতি যাতে অর্থায়নকারী ব্যাংক সরাসরি ঋণ আকারে অর্থ প্রদানের পরিবর্তে তাদের গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে পণ্যসামগ্রী বাজার থেকে ক্রয় করে; অতঃপর খরচ দামের ওপর ব্যাংকের মুনাফা (Mark up) যোগ করে গ্রাহকের কাছে বাকিতে বিক্রি করে। এটা যথার্থ অর্থে অর্থায়ন নয়; বরং এটি গ্রাহকের নিকট মাল বিক্রয় করা।’

 

৬. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর শরী’আহ্ কাউন্সিলের মতে, “কোন পণ্যের ক্রয়মূল্যের ওপর ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিতে নির্ধারিত লাভে বিক্রয় করাকে বায়’ মুরাবাহা বলে। এ পদ্ধতিতে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ের সম্মতিতে ক্রয়মূল্যের ওপর নির্ধারিত লাভে পণ্য বিক্রয় করা হয়।

 

৭. ড. মাহফুজুর রহমানের মতে, “বিক্রেতা কর্তৃক তার ক্রয়মূল্য ক্রেতাকে জানিয়ে তার ওপর সুনির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ যোগ করে পণ্য বিপণন করা হলে তাকে বলা হয় ‘বায়’ ‘মুরাবাহা’

 

৮. ড. মোঃ আবু বকর সিদ্দীক লিখেছেন, “যে ক্রয়-বিক্রয়ে বিক্রেতা বিক্রীত পণ্যের ব্যয় সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দেয় এবং তার ওপর কিছু মুনাফা সংযোজন করে অন্যের নিকট বিক্রি করে তাকে বায়’ মুরাবাহা বলে ।

 

৯. ড. শহীদ হাসান সিদ্দীকির মতে, “Murabahah means mutually stipulated of profit in a sale transaction where the cost of the commodity is made known to the buyer. The parties negotiate the profit margin on the known cost.”

 

১০. ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়ার মতে, “মুরাবাহা পদ্ধতি চুক্তির ভিত্তিতে লাভে বিক্রয়। কোনো ক্রেতার ফরমায়েস অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংক নির্দিষ্ট দ্রব্যসামগ্রী বা মালামাল ক্রয় করে তা ক্রেতার নিকট কিছু বেশি দামে বা লাভে বিক্রয়ের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ক্রেতা ব্যাংকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট লাভে ঐ জিনিস ক্রয় করার অঙ্গীকার করেন। ক্রয়মূল্যের সাথে অন্যান্য খরচ, ব্যাংকের লাভ যোগ করা হয়।

 

ইসলামী শরীআহর দলিল(Evidence of Islamic Shariyah)

 

বায়’ যেহেতু বৈধ তাই ইসলামের দৃষ্টিতে বায়’ মুরাবাহাও সম্পূর্ণ বৈধ। কারণ আল্লাহ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয়কে বৈধ করেছেন।

 

১. কুরআনের বাণী-

 

وَاحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا

 

অর্থাৎ, “আল্লাহ্ তা’আলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদ হারাম করেছেন।”

 

عَنْ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ : أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ مَعَهُ بِدِينَارٍ يَشْتَرِي لَهُ أَضْحِيَّةً فَاعْتَرَاهَا بِدِينَارٍ، وَبَاعَهَا بِدِينَارَيْنِ، فَرَجَعَ فَاعْتَرَى لَهُ أُطحِيَّةً بِدِينَارٍ. وَجَاءَ بِدِينَارٍ إِلَى النّبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَتَصَدَّقَ بِهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَدَعَا لَهُ أَنْ يُبَارَكَ لَهُ فِي تِجَارَتِهِ

 

অর্থাৎ, “হযরত হাকিম ইবনে হিযাম (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি কুরবানির পশু খরিদ করার জন্য এক দিনার দিয়ে তাকে বাজারে পাঠালেন। তিনি এক দিনার দিয়ে একটি দুম্বা ক্রয় করলেন এবং ওটা দুই দিনারে বিক্রি করলেন। অতঃপর তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। আবার গিয়ে এক দিনার দিয়ে একটি কুরবানির পশু ক্রয় করলেন। অতঃপর পশু ও অতিরিক্ত দিনার এনে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রদান করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তা দান করে দিলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন যেন তাঁর ব্যবসায়ে বরকত (লাভ) হয়। ” অধিকাংশ ফকিহ বায়’ মুরাবাহার বৈধতার প্রমাণ হিসেবে একেই নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

 

সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়িগণ মুরাবাহা ধরনের ক্রয়-বিক্রয় করেছেন বলে জানা যায়

 

عَنْ أَبِي بَحْرٍ, عَنْ شَيْحٍ لَهُمْ, قَالَ: رَأَيْتُ عَلَى عَلِي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ إِزَارًا غَلِيظًا قَالَ: اشْتَرَيْتُ بِخَمْسَةِ دَرَاهِمَ فَمَنْ أَرْبَحَنِي فِيهِ دِرْ هَمَّا بِعْتُهُ إِيَّاهُ

 

অর্থাৎ, “আবু বাহার থেকে বর্ণিত, তিনি তাদের এক শায়খ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আল (রা.)-এর কাঁধের উপর একটি মোটা চাদর দেখতে পেলাম । তখন আলী (রা.) বললেন, আমি এটা পাঁচ দিরহামে কিনেছি। যে আমাকে এর ক্রয় মূল্যের ওপর এক দিরহাম লাভ দিবে আমি তার কাছে তা বিক্রয় করব। “

 

বায়হাকী তার ‘সুনানুল কুবরা’ নামক গ্রন্থে উপরিউক্ত হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন, আমরা হযরত কাযী শোরাইহ (রা.) হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব (রা.) ও হযরত ইব্রাহীম নাখায়ী (রা.) থেকেও বর্ণনা করেছি যে, তারা সকলে দশ টাকার ওপর (দুই টাকা লাভ করে) বারো টাকায় বিক্রি করার অনুমতি দিয়েছেন। অর্থাৎ তারা সকলে ‘বায়’ মুরাবাহা’র অনুমতি দিয়েছেন।

 

হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমতি দিয়েছেন। তবে শর্ত আরোপ করেছেন যে, মূল্যের ওপর পড়তা খরচের জন্য কোনো লাভ নেয়া যাবে না। হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব (র.)ও এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমতি দিয়েছেন। কাযী শোরাইহ্ ও ইবনে সীরিন বলেছেন, এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় হতে পারে এবং পড়তা খরচও পণ্যের মূল্যের সাথে যোগ করা যায়’।

 

৪. ইবনে রুশদ বলেন, আলিমগণ এ ব্যাপারে ‘ইজমা’য় উপনীত হয়েছেন যে, ক্রয়-বিক্রয় দুই ধরনের। ‘মুসাওমা’ ও ‘মুরাবাহা’। ‘মুরাবাহা’ হলো বিক্রেতা কর্তৃক ক্রেতাকে তার ক্রয়মূল্য জানিয়ে এমন শর্ত আরোপ করা যে, তাকে অত দীনার বা দিরহাম বেশি বা লাভ দিতে হবে।

 

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক-এর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে বায়’ মুরাবাহা পদ্ধতি ব্যবহার করছে। মুরাবাহা পদ্ধতির বৈধতা সম্পর্কে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আলিম ও ফকিহগণের রায় রয়েছে। এছাড়া ১৯৭৯ সালের মে মাসে সংযুক্ত আরব আমীরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ক সম্মেলন, ১৯৮৩ সালের ২১- ২৩ মার্চ কুয়েতে অনুষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ক সম্মেলন এবং ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে কুয়েতে অনুষ্ঠিত ওআইসির ইসলামী ফিক্হ্ একাডেমির সম্মেলন, ‘মুরাবাহা লিল আমিরি বিশ্ শিরা’ পদ্ধতির বেচা-কেনাকে বৈধ বলে রায় দেওয়া হয়।

 

মুরাবাহা ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক উদ্ভাবিত নতুন কোনো পদ্ধতি নয়। এমন ধারণা করার কোনো কারণ নেই যে, ইসলামী ব্যাংক ঘুরিয়ে সুদ খাওয়ার জন্য এ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছে; বরং ইসলামী ব্যাংকের জন্মের শত শত বছর পূর্বেও এ পদ্ধতিতে মানুষ ক্রয়-বিক্রয় করেছে। এটা পূর্ববর্তী ফকিহগণের নিকট পরিচিত ছিল। ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর ছাত্র ইমাম মুহাম্মদ বিন হাসান আশ শায়বানী (রহ) এ ধরনের ক্রয়- বিক্রয়ের উল্লেখ করেছেন, ইমাম মালিক (রহ) মুয়াত্তায় উল্লেখ করেছেন এবং ইমাম শাফিঈ (রহ) তাঁর কিতাবুল উম্মে আলোচনা করেছেন। এজন্য ইসলামী ফিকহের প্রাচীন গ্রন্থসমূহে মুরাবাহা নামে স্বতন্ত্র অধ্যায় রয়েছে। শরী’আহর দৃষ্টিতে সেখানে মুরাবাহার সকল খুঁটিনাটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বিজ্ঞ ফিক্হ শাস্ত্রবিদগণ।

যেমন : ‘হিদায়া’ নামক কিতাবে ‘মুরাবাহা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রয়েছে, যেটা এখনো বাংলাদেশের আলীয়া ও কওমী মাদ্রাসায় পড়ানো হয়। ইসলামী ব্যাংক সে মুরাবাহাকে বাস্তবে প্রয়োগ করছে মাত্র।

 

বায়মুরাবাহার প্রকারভেদ(Classification of Bai Murabaha)

ক. মূল্য পরিশোধের দিক দিয়ে বায়’ মুরাবাহা দুই প্রকার। যথা :

 

. বায়মুরাবাহা বিন নবদ নগদ মূল্যে বায়মুরাবাহা) : মুরাবাহা মাল নগদেও বিক্রয় করা যায়। পণ্যের বিক্রয়মূল্য তাৎক্ষণিক প্রতিশোধিত হলে তাকে বায়’ মুরাবাহ বলে।

 

. বায়মুরাবাহা বিল আজল (রা নির্ধারিত সময়ের জন্যে مر বাকি মূল্যে বায়মুরাবাহা) : মুরাবাহা মাল বাকিতেও বিক্রয় করা যায়। পণ্যের মূল্য ভবিষ্যতের কোনো সুনির্দিষ্ট সময়ে (বাকিতে) পরিশোধের অঙ্গীকার হলে তাকে বায়া মুরাবাহ বিল আজল বলা হয়।

 

খ. কেউ কেউ বায়’ মুরাবাহার নিম্নোক্তভাবেও ভাগ করে থাকেন- মুরাবাহা বায়’ মু’আজ্জাল যদি চুক্তি এমনভাবে হয় যে, ক্রেতা পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মূল্য পরিশোধ করবে; কিন্তু মালামাল আগে বিতরণ হবে তা হলে একে বলা হয় মুরাবাহা বায়’ মু’আজ্জাল ।

 

মুরাবাহা বায়সালাম : চুক্তির সময় ক্রেতা সমস্ত (লাভসহ) পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে দেয় এবং পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাংক মাল সংগ্রহ করে ক্রেতাকে সরবরাহ করে থাকে, তাহলে এ ধরনের বিক্রয়কে মুরাবাহা বায়’ সালাম বলে। এ ক্ষেত্রে মালামাল সরবরাহের দিন ও তারিখ নির্দিষ্ট থাকবে। বর্ণিত তারিখে গ্রাহক মালামাল গ্রহণ করবেন।

 

গ. লেনদেনকারী পক্ষগুলোর দিক দিয়ে বায়’ মুরাবাহা দু’রকম। যথা :

 

১. মুরাবাহা আদিয়া বা সাধারণ বায়’ মুরাবাহা (General Murabaha) : ক্রেতার অনুরোধ ছাড়াই বিক্রেতা কর্তৃক কোনো পণ্য ক্রয় করে মালিকানা ও দখল লাভের পর ক্রয়মূল্যের সাথে নির্ধারিত মুনাফা যোগ করে বিক্রি করাকে বায়’ মুরাবাহা আদিয়া বা সাধারণ বায়’ মুরাবাহ বলা হয়। সাধারণ বায়’ মুরাবাহা হচ্ছে একজন ক্রেতা ও একজন বিক্রেতার মধ্যে প্রত্যক্ষ লেনদেন। এক্ষেত্রে বিক্রেতা হলেন একজন সাধারণ ব্যবসায়ী যিনি মুনাফার জন্য অন্য জনের কাছে বিক্রয়ের আশায় বাজার থেকে পণ্য ক্রয় করে থাকেন। এখানে ক্রয়কৃত পণ্যের ব্যাপারে পুঁজি বিনিয়োগের পুরো ঝুঁকিটাই বিক্রেতা নিয়ে থাকেন। পণ্যের ক্রেতা পাওয়ার যোগ্যতার ওপর তার মুনাফা অর্জন করা না করা নির্ভর করে। প্রাচীন ফিক্বহের গ্রন্থসমূহে মুরাবাহা বলতে এ ধরনের মুরাবাহার কথাই বলা হয়েছে।

 

২. মুরাবাহা লিল্ আমিরি বিশশিরা বা আদেশ ও অঙ্গীকারভিত্তিক বায়’ মুরাবাহা (Murabaha to purchase order) : ক্রেতার অনুরোধে তার চাহিদা মোতাবেক বিক্রেতা কর্তৃক পণ্য ক্রয় করে মালিকানা ও দখল লাভের পর ক্রয়মূল্যের সাথে সম্মত মুনাফা যোগ করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণপূর্বক উক্ত ক্রেতার কাছে বিক্রি করাকে বায় মুরাবাহা লিল্ আমিরি বিশ্ শিরা বলে। এ ধরনের মুরাবাহাকে ব্যাংকিং মুরাবাহা বলা হয়। এই লেনদেনে পক্ষ থাকে তিনটি- ক্রেতা, বিক্রেতা ও ব্যাংক। ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যাংক ভূমিকা পালন করে থাকে। অন্য কথায়, নির্দিষ্ট কোনো মালামাল বা পণ্যের জন্য গ্রাহক ক্রেতার কাছ থেকে অর্ডার ও চুক্তির পর ব্যাংক বিক্রেতার নিকট থেকে সেটি ক্রয় করবে। ইসলামী ব্যাংকসমূহ কেবল গ্রাহকের ক্রয় আদেশের বিপরীতে ‘মুরাবাহা’ পদ্ধতি অনুশীলন করছে। তাই ইসলামী ব্যাংকসমূহ যে মুরাবাহা করছে তাকে ‘মুরাবাহা লিল্‌ আমিরি বিশ্ শিরা’ বলা হয়। এ পদ্ধতিতে ব্যাংক আগ্রহী গ্রাহকের অর্ডার পাওয়ার পর কেবল বাজার থেকে পণ্য ক্রয় করে। অতঃপর উক্ত মালামাল গ্রাহকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করে থাকে। অবশ্য, এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক অর্থের যোগানদাতা হিসেবে কাজ করে থাকে। এর অর্থ এই নয় যে, ভোক্তা কর্তৃক জিনিসপত্র কেনার জন্য ব্যাংক অর্থ প্রদান করে। এ কারণে মনে হতে পারে, এই লেনদেন ঐ ঋণ নেয়ার চেয়ে বেশি কিছু নয় যার বিনিময়ে সুদ আদায় করা হয়। অথচ এটা ইসলামী আকিদার পরিপন্থি।

 

বায়মুরাবাহা কারবারের পদ্ধতি(Bai Murabaha Business System)

 

বায়’ মুরাবাহা কারবারের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হয়। যেমন-

 

১. প্রস্তাব : ব্যাংকের কাছে গ্রাহক নিজের প্রয়োজনের ব্যাপারে প্রস্তাব পেশ করেন। ব্যাংক থেকে যে পণ্য নিতে চান, তার স্পেসিফিকেশন উল্লেখপূর্বক প্রস্তাব প্রেরণ করেন। এতে পণ্যের ডেলিভারির তারিখ, সময় ও স্থান, মূল্য এবং পরিশোধের ধরন বর্ণিত থাকে। ক্রেতার উল্লিখিত মূল্য গ্রহণ কিংবা ভিন্ন কোনো মূল্য উল্লেখ করে ব্যাংক জবাবি প্রস্তাবের মাধ্যমে সাড়া দেয় ৷

 

২. ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর: ক্রয়ের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর প্রদান। বায়’ মুরাবাহার ভিত্তিতে এবং বর্ণিত মূল্যের বিনিময়ে ব্যাংক থেকে পণ্য ক্রয়ের জন্যে গ্রাহক অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। ব্যাংক অর্ডারটি গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট লেন-দেনের শর্তাবলি নির্ধারণ করে।

 

৩. বিক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর : প্রথম বিক্রয় চুক্তি। ক্রয়ের চুক্তি অনুমোদনের বিষয়ে ব্যাংক গ্রাহককে (চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি ক্রেতা) অবহিত করে। ব্যাংক পণ্যের মূল্য সাথে সাথে কিংবা চুক্তিমাফিক প্রদান করতে পারে। বিক্রেতা নির্ধারিত পণ্য বিক্রয় অনুমোদন করে তা জানিয়ে দেয় এবং চালান (ইনভয়েস) প্রেরণ করে।

 

৪. মুরাবাহা চুক্তি স্বাক্ষর: মুরাবাহা বিক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করা। উভয়পক্ষ (ব্যাংক ও গ্রাহক) ক্রয় চুক্তি মোতাবেক বায়’ মুরাবাহা বিক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করে।

 

৫. পণ্য বিনিময় পণ্যের ডেলিভারি ও গ্রহণ। পণ্য বুঝে নেওয়ার জন্য ব্যাংক গ্রাহক বা তার নমিনীকে অধিকার প্রদান করে। সম্মতি আছে, এমন কোনো স্থানে বিক্রেতা পণ্য প্রেরণ করে থাকেন। আইনসম্মত প্রতিনিধিরূপে গ্রাহক পণ্য বুঝে নেওয়ার কাজটি করেন এবং ব্যাংককে এ বিষয়ে অবগত করেন।

 

বায়মুরাবাহার বৈশিষ্ট্য(Characteristics of Bai Murabaha)

 

. তিনটি পক্ষ : বায়’ মুরাবাহাতে ব্যাংকের ক্ষেত্রে তিনটি পক্ষ থাকে । যথা : (ক) প্রথম বিক্রেতা (সরবরাহকারী- যার নিকট থেকে প্রথমবার পণ্য ক্রয় করা হয়); (খ) প্রথম ক্রেতা (ব্যাংক-অর্থায়নকারী) যিনি পরে আবার বিক্রেতা; (৩) দ্বিতীয় ক্রেতা (বিনিয়োগ গ্রাহক) যিনি প্রথম ক্রেতার নিকট থেকে ক্রয় করেন।

 

দ্বিতীয় ক্রেতা (বিনিয়োগ গ্রাহক)-কে নগদ সুবিধা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কোনো বিক্রেতার নিকট হতে মালামাল ক্রয় করে পুনরায় তার নিকট বিক্রয় করা- এরূপ শর্তে বিক্রয় করা বৈধ হবে না।

 

. পণ্য ক্রয় করে দেয়ার জন্য লিখিত অনুরোধ : ব্যাংকিং বায়’ মুরাবাহার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ গ্রাহক স্বীয় চাহিদানুযায়ী পণ্য ক্রয় করে দেয়ার জন্য ব্যাংককে অনুরোধ করবেন এবং ব্যাংক কর্তৃক উক্ত পণ্য ক্রয়ের পর গ্রাহক তা ক্রয় করে নেয়ার অঙ্গীকার করবেন।

 

. ক্রয়মূল্য মুনাফার পরিমাণ গ্রাহককে জানানো : বায়’ মুরাবাহা চুক্তির সময় পণ্যের ক্রয়মূল্য, আনুষঙ্গিক খরচ (যদি থাকে) ও মুনাফার পরিমাণ সুস্পষ্টভাবে গ্রাহককে জানাতে হবে। অর্থাৎ বিক্রয়ের সময় মুরাবাহা পণ্যের ক্রয়মূল্য ও মুনাফা ক্রেতাকে আলাদাভাবে জানাতে হবে। মঞ্জুরিপত্রের এবং পারচেজ সিডিউলের সকল ঘর সঠিকভাবে পূরণ হতে হবে। ক্যাশমেমো ব্যাংকের নামে হতে হবে এবং ক্যাশমেমো ব্যাংকের রেকর্ডের সাথে সাথে অন্তর্ভুক্ত হবে। বিনিয়োগ বিতরণের তারিখে ক্যাশমেমো নিতে হবে এবং বিতরণকৃত বিনিয়োগ পরিমাণের সাথে ক্যাশমেমোর মিল থাকতে হবে ।

 

. মুনাফা (Profit) :মুনাফা অর্জনই মুরাবাহা কারবারের প্রধান উদ্দেশ্য। মুনাফা ছাড়াও ক্রয়-বিক্রয় হতে পারে; কিন্তু তা বায়’ মুরাবাহা নয়। বায়’ মুরাবাহার ক্ষেত্রে লোকসানের প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক।

 

. পণ্যের অস্তিত্ব : বায়’ মুরাবাহার চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পণ্যের অস্তিত্ব থাকতে হবে।

 

. ক্রয়কৃত মালামালের মালিকানা বা দখল প্রতিষ্ঠা : ক্রেতার কাছে বিক্রি করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট মালামাল ব্যাংকের মালিকানা ও দখলে থাকতে হবে।  ব্যাংক কর্তৃক বায়’ মুরাবাহা লিল আমিরি বিশ্ব শিরা পদ্ধতিতে গ্রাহকের কাছে মালামাল বিক্রির পূর্বে উক্ত মালামালের প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে মালিকানা অর্জন বাধ্যতামূলক। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যবসায়ীদেরকে তাদের ব্যবসার মাল নিজের দখলে আনার পূর্বে বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। তাই মাল ক্রয় করে মালিকানা লাভ করার পর বিক্রয় করা হচ্ছে শর্ত। মালামালের মালিকানা লাভ করা ও দখল ব্যতীত কোনো মাল বিক্রয় করা শরী’আহসম্মত হয় না। পণ্যসামগ্রী বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংককে প্রথমে ক্রয় বা অন্য যেকোনো বৈধ পন্থায় উক্ত পণ্যের উপর মালিকানা অর্জন করতে হবে এবং দখল লাভের মাধ্যমে পণ্যসমাগ্রীর মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের বিক্রেতা হতে মালামাল বুঝে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাংক প্রতিনিধি মাল বুঝিয়ে দেবেন এবং পণ্য বুঝে নেয়ার যথাযথ রেকর্ড রাখতে হবে।

 

. রূপান্তর : মাল ক্রয় করে অর্থকে মালে রূপান্তর এবং মাল বিক্রি করে মালকে অর্থে রূপান্তর করা হয় (Transformation of money into goods and then transformation of goods into money)। রূপান্তরের সুযোগ ও ঝুঁকি থাকার কারণেই এ পদ্ধতি শরী’আহ্সম্মত। এ পদ্ধতিতে ব্যাংক কখনও গ্রাহককে টাকা দেয় না। জিনিস ক্রয় করে তা বিক্রয় করে থাকে।

 

. ঝুঁকি বহন : মাল ক্রয়ের পর ক্রেতার / গ্রাহকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করার পূর্ব পর্যন্ত মালের ঝুঁকি (Risk) বহন করতে হয়। মাল ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করার পূর্ব পর্যন্ত মালের যাবতীয় ঝুঁকি ব্যাংককেই বহন করতে হয়।

 

. মালিকানা : বিনিয়োগকৃত মালামালের মালিকানা বিনিয়োগ গ্রাহকের নিকট থাকে। অন্যকথায় মালামাল গ্রাহকের কাছে হস্তান্তরের পর গ্রাহকই মালের মালিক হয় আর ব্যাংক হয় মালের জামানতদার।

 

১০. পণ্যের নিরাপত্তা সংরক্ষণ খরচ : বায়’ মুরাবাহা পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পণ্য যখন যার মালিকানায় থাকবে, নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের যাবতীয় খরচ তখন তাকেই বহন করতে হবে।

 

১১. হালাল পণ্য : ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্য অবশ্যই হালাল পণ্য হতে হবে যা ইসলামী শরী’আহতে নিষিদ্ধ নয়। শরী’আহ্ দৃষ্টিতে অবৈধ মালের জন্য মুরাবাহা চুক্তি করা যাবে না।

 

১২. পণ্য অর্থের বিনিময় : বায়’ মুরাবাহার ক্ষেত্রে একদিকে মালামাল অন্যদিকে টাকার বিনিময় হয়।

 

১৩. মূল্য নির্ধারণ : বায়’ মুরাবাহার ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ ইনসাফভিত্তিক হতে হবে।

 

১৪. মালামাল নেয়া মূল্য পরিশোধ : চুক্তিবদ্ধ বিনিয়োগ গ্রাহক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মালামালের সরবরাহ নিতে ও মূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য থাকেন।

 

 ১৫. জামানত : ব্যাংক প্রয়োজনবোধ করলে বিনিয়োগ গ্রাহকের নিকট থেকে সহায়ক জামানত গ্রহণ করতে পারে।

 

১৬. মালামাল জামানত : ব্যাংক বিনিয়োগ গ্রাহকের নিকট থেকে একই প্রকারের অতিরিক্ত মালামাল জামানত হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। যে পর্যন্ত ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত অর্থ গ্রাহক কর্তৃক পরিশোধিত না হয়, ততোদিন পর্যন্ত গ্রাহকের পক্ষ হয়ে ক্রয়কৃত মাল ব্যাংকের নিকট সিকিউরিটি হিসেবে দায়বদ্ধ থাকে। কিস্তিতে মূল্য পেলে ব্যাংক গোডাউন থেকে কিস্তিতে সমমূল্যের মাল ছেড়ে দেয়।

 

১৭. মালামাল ডেলিভারি : বিনিয়োগ গ্রাহক সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে সব মালামাল একসাথে সরবরাহ নিতে পারেন, আবার কিস্তিতে আনুপাতিক মূল্য পরিশোধ করে আংশিক মালামালও নিতে পারেন।

 

১৮. লিখিত চুক্তি : বায়’ মুরাবাহা চুক্তি লিখিত হতে হবে এবং সাক্ষী থাকবে।

 

১৯. বিক্রয় চুক্তি পরিবর্তন বা পরিবর্ধন : বিক্রয় চুক্তির শর্তাবলি কার্যকর হয়ে যাবার পর আর কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন অনুমোদনযোগ্য নয় ।

 

২০ মুনাফা নির্ধারণ : মুরাবাহার ক্ষেত্রে শতকরা বা % হিসাবে নির্ধারণ করা হলেও হালাল হবে। চুক্তির পর নির্ধারিত মূল্য বৃদ্ধি করা যায় না। অন্যকথায় মুরাবাহা পদ্ধতিতে একবার মূল্য নির্ধারণ হয়ে গেলে তা আর পরিবর্তন করা যায় না। ড. মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন লিখেছেন, মুরাবাহার ক্ষেত্রে লাভ থেকে (Lump Sum) অথবা শতকরা (Percentage) যেকোনো পদ্ধতিতে ধার্য করা শরী’আতে বৈধ। এ পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মুনাফা বা লাভ নির্ধারিত (Fixed Profit) হওয়া। মুনাফা নির্ধারিত না হলে মুরাবাহা শুদ্ধ হবে না।

 

২১ লেটার অব অথরিটি নেয়া : আমদানি-উত্তর মুরাবাহা (Post Import Murabaha) ও ডিলারশিপের ক্ষেত্রে গ্রাহক থেকে লেটার অব অথরিটি (Letter of Authority) নিতে হবে। দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বরাদ্দপত্র/লাইসেন্স/ ডিলারশীপ/এল. সি ইত্যাদির ক্ষেত্রে কেবল অনুমোদিত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান মালামাল উত্তোলন, ক্রয় ও আমদানি করে তা বাজারে বিক্রি করে থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃক সরাসরি নিজ নামে মালামাল উত্তোলন, ক্রয় ও আমদানির সুযোগ নেই। উপরিউক্ত ক্ষেত্রসমূহে অনুমোদিত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান মালামাল/ক্রয়/উত্তোলন/আমদানির জন্য ব্যাংকের বিনিয়োগ সুবিধা পেতে আগ্রহী। উল্লিখিত ক্ষেত্রসমূহে অনুমোদিত ব্যক্তি/ ডিলার/প্রতিষ্ঠান/এল. সি হোল্ডার-এর নিকট থেকে ব্যাংককে সংশ্লিষ্ট মালামাল ক্রয়ের অথরাইজেশন (Letter of Authority) নিতে হবে। অতঃপর ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠানকে তার উকিল/ এজেন্ট নিয়োগ করে তার মাধ্যমে মাল ক্রয় করে তার নিকট বিক্রি করতে পারে।

 

২২. চুক্তিপত্র পূরণ : বায়’ মুরাবাহা চুক্তিপত্র যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে। কোনভাবেই চুক্তিপত্র খালি ও তারিখবিহীন রাখা যাবে না।

 

বায়মুরাবাহার শর্তাবলি(Terms of Bai Murabaha) মুরাবাহা পদ্ধতির শর্তাবলি নিম্নরূপ

 

১. মুনাফা ও পণ্য মূল্য মিলিয়ে নির্ধারিত পরিমাণসম্মত মূল্যে নির্দিষ্ট পণ্য ব্যাংকের কাছ থেকে ক্রয়ের জন্য গ্রাহক প্রস্তাব দিতে পারেন।

 

২. একজন গ্রাহক ব্যাংকের কাছ থেকে ক্রয়ের জন্য ওয়াদাবদ্ধ হতে পারেন। এর অর্থ, তাকে হয় ওয়াদা পূরণ করতে হবে, নতুবা অকারণে ওয়াদা ভঙ্গ করলে যে ক্ষতি হবে, তা পূরণ করে দিতে হবে। এই ওয়াদা বাস্তবায়নের গ্যারান্টি দিতে কিংবা ক্ষতিপূরণ বাবদ নগদ অর্থ অথবা অন্য কিছু জামানত হিসেবে রাখার অনুমতি রয়েছে।

 

৩. গ্রাহকের কাঙ্ক্ষিত মালামাল ব্যাংক কর্তৃক প্রথমে ক্রয় করার ক্ষেত্রে যদি সরবরাহকারী থেকে দরপত্র আনা হয় বা সরবরাহকারী যদি দরপত্র দাখিল করেন তাহলে তা ব্যাংকের বরাবর হওয়া উচিত। কেননা ব্যাংক হচ্ছে প্রথম ক্রেতা।

 

৪. বায়’ মুরাবাহা চুক্তির জন্য অন্যতম মৌলিক শর্ত হলো, পণ্যের মওজুদ ও প্রাপ্তি। অতএব ব্যাংককে অবশ্যই গ্রাহকের সুনির্দিষ্ট চাহিদা মোতাবেক পণ্য কিনতে হবে। এভাবে গ্রাহকের সাথে বায়’ মুরাবাহা চুক্তি স্বাক্ষর করার আগে ব্যাংককে সংশ্লিষ্ট পণ্যের মালিকানা অর্জন করতে হবে।

 

৫. ব্যাংক কর্তৃক ক্রেতাকে সরবরাহ করার পূর্ব পর্যন্ত পণ্যের ক্ষতি, ত্রুটি অথবা নষ্ট হওয়ার জন্যে ব্যাংক দায়ী থাকবে।

৬. ব্যাংক গ্রাহককে অবশই চুক্তিতে বর্ণিত তারিখ, সময় ও স্থানে পণ্য ডেলিভারি’

 

৭. ব্যাংকের পরিবর্তে বিনিয়োগ গ্রাহক ও মালামাল সরবরাহকারীর মধ্যে ইজাব ও কবুল হয়ে গেলে তাদের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়ে যাবে এবং মালামাল বিনিয়োগ গ্রাহকের মালিকানাধীন হয়ে যাবে। এখানে গ্রাহক কর্তৃক মূল্য পরিশোধ না করা (অর্থাৎ ব্যাংক কর্তৃক মূল্য পরিশোধ করাটা) চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নয়। কেননা চুক্তি সম্পন্ন অথবা বিশুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধ কোনো শর্ত নয়। মূল্য হলো চুক্তির ফল। এটা চুক্তির কোনো রুকন বা শর্ত নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ও বিনিয়োগ গ্রাহকের মধ্যে ‘ক্রেতা-বিক্রেতা’ সম্পর্ক না হয়ে বরং ‘ঋণগ্রহীতা’ সম্পর্ক হবে। অর্থাৎ গ্রাহক মালামাল ক্রয় করে বিক্রেতার কাছে ঋণী হয়েছেন আর ব্যাংক তার ঋণ পরিশোধ করার জন্যে তাকে ঋণ দিয়েছে বলে ধর্তব্য হবে।

 

৮. মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যাংক তার খরচের চেয়ে বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রয় করবে। বায়’ মুরাবাহায় এই বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত হয় ক্রেতার সম্মতি অনুসারে। মুনাফার উল্লেখ করা যায় সরাসরি ডলারের পরিমাণে কিংবা ক্রয়মূল্যের শতকরা হারের হিসাবে। তবে শতকরা হার ব্যবহৃত হয়ে থাকলে তা কখনোই মেয়াদের ভিত্তিতে উল্লে- খ করা উচিত হবে না। এই মূল্যকে এক ধরনের সুদ মনে করার বিভ্রান্তি যাতে সৃষ্টি না হয়, সে জন্য এটা করা দরকার।

 

৯. চুক্তিতে যে মূল্যের ব্যাপারে সম্মতি থাকবে, সেটা মেনে নেওয়া উভয় পক্ষের জন্যেই বাধ্যতামূলক ।

 

১০. ব্যাংকের পক্ষে পণ্যগুলো ক্রয় ও গ্রহণ করার জন্য তৃতীয় পক্ষের সাথে চুক্তি করার অনুমতি ব্যাংকের রয়েছে। এই চুক্তি অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন হতে হবে।

 

১১. গ্রাহক ও সরবরাহকারী একই ব্যক্তি হওয়া বৈধ নয়। কেননা তা বায়’ উল “ঈনা হয়ে যাবে। মালামাল সরবরাহকারী বিনিয়োগ গ্রাহকের নিকটাত্মীয় এমনকি স্বামী অথবা স্ত্রী হলেও সমস্যা নেই। তবে প্রত্যেকটির পৃথক আইনগত সত্তা থাকা প্রয়োজন, যেন কোনোক্রমেই পাতানো ক্রয়-বিক্রয় না হয়।

 

১২. চুক্তি করার (প্রস্তুত করার) খরচ উভয় পক্ষের (ব্যাংক ও গ্রাহকের) বহন করায় শরী’আহ’র দৃষ্টিতে কোনো বাধা নেই। এমনকি এক পক্ষের বহন করা শর্ত থাকলে তাতেও অসুবিধা নেই।

 

১৩. পণ্য স্থানান্তরের ঝুঁকি কেবল গ্রাহকের বহন করা বৈধ নয়। কেননা পণ্য যখন যার মালিকানায় থাকবে তখন ঝুঁকি তাকেই বহন করতে হবে।

 

১৪. সরবরাহকারীকে সরাসরি ব্যাংক কর্তৃক মূল্য পরিশোধ করা, যেন লেনদেনে সুদের আদান-প্রদানে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে।

 

১৫. পণ্য ব্যাংকের মালিকানায় আসার পূর্বে বিক্রয় করা বৈধ নয়। তাই বিক্রয়ের পূর্বে ব্যাংক কর্তৃক মালামালের উপর মালিকানা অর্জন আবশ্যক।

 

১৬. গ্রাহকের নিকট বিক্রয়ের পূর্বে মালামাল ব্যাংকের দখলে আসা আবশ্যক। ব্যাংকের দখলে থাকা অবস্থায় মালামাল নষ্ট হলে তার দায়-দায়িত্ব ব্যাংককে বহন করতে হবে।

 

১৭. ব্যাংক তার প্রয়োজনে বিনিয়োগ গ্রাহক ব্যতীত অন্য কাউকে উকিল নিয়োগের ব্যাপারে অগ্রাধিকার প্রদান করবে।

 

১৮. বিনিয়োগ গ্রাহককে উকিল নিযুক্ত করার ক্ষেত্রে তার দু’টি দায়িত্বের মধ্যে। সুস্পষ্ট সীমারেখা থাকা আবশ্যক। উকিল হিসেবে দায়িত্ব এবং বিনিয়োগ গ্রাহক/ক্রেতা হিসেবে দায়িত্বের মধ্যে যেন সংমিশ্রণ না ঘটে।

 

১৯. মুরাবাহার ক্ষেত্রে কবদে হুকমি (পরোক্ষ দখল) যথেষ্ট। পণ্য তার প্রকৃতি অনুযায়ী কবদ করা যাবে। কেননা শরী’আহ করদ করার জন্যে কোনো পদ্ধতি নির্ধারণ করেনি; বরং এটাকে প্রচলিত প্রথার (উষ্ণ) ওপর ছেড়ে দিয়েছে। করদ করার উদ্দেশ্য হলো ব্যয়-ব্যবহার করার ক্ষমতা অর্জন করা। সুতরাং যেভাবে সে ক্ষমতা অর্জিত হবে তাই কবদ বলে গণ্য হবে।

 

২০. গ্রাহককে ক্রয় প্রতিনিধি নিযুক্তির ক্ষেত্রে মুরাবাহা চুক্তি ও প্রতিনিধি নিয়োগের মধ্যে সন্দেহ দূরীভূত করার জন্যে প্রত্যেকটি চুক্তি আলাদা হতে হবে।

 

২১. ক্রয়সংক্রান্ত দলিলাদি (ডকুমেন্টস) ব্যাংকের নামে হতে হবে। কেননা ব্যাংকের স্বার্থেই ক্রয় সংঘটিত হচ্ছে।

 

২২. দ্বিতীয় ক্রেতাকে (বিনিয়োগ গ্রাহক) ক্রয়মূল্য জানাতে হবে। (অজ্ঞাত রেখে করলে শুদ্ধ হবে না ।

 

২৩. লাভ সুনির্দিষ্ট হতে হবে। কেননা লাভ বিক্রয়ের অংশ, আর মূল্য ঠিক করা ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হওয়ার পূর্বশর্ত।

 

২৪. প্রথম ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হতে হবে, কেননা প্রথম চুক্তি শুদ্ধ না হলে বিক্রয়টিও শুদ্ধ হবে না।

 

২৫. মুরাবাহার ভিত্তিতে দ্রব্যের কোনো ত্রুটি থাকলে বিক্রেতার উচিত উক্ত ত্রুটি ক্রেতাকে জানানো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *