ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার অন্তর্নিহিত শক্তিসমূহ

ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার অন্তর্নিহিত শক্তিসমূহ

ইসলামী ব্যাংক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তার মৌলিক বিধান ও কর্ম- পদ্ধতির সকল স্তরে ইসলামী শরীয়ার নীতিমালা মেনে চলতে বদ্ধপরিকর এবং কর্মকাণ্ডের সকল পর্যায়ে সুদকে বর্জন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ ইসলামী সম্মেলন সংস্থার গৃহীত এই সংজ্ঞা পৃথিবীর সকল দেশের ইসলামী ব্যাংকসমূহের কার্যক্রমের ভিত্তি। এই সংজ্ঞার মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার পরিচয়ও সম্যকরূপে বিধৃত ।

 

ইসলামের আর্থ-সামাজিক মূলনীতির আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার চেতনা ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রেরণারূপে কাজ করেছে। ইসলামী শরীয়ার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে এ ব্যাংকের সকল লেনদেন সুদের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত এবং সেইসাথে আর্থ-সামাজিক সুবিচার ও মানুষের সার্বিক উন্নয়ন এ ব্যাংক ব্যবস্থার লক্ষ্য ।

 

ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার পার্থক্য নীতিগত এবং মৌলিক। ইসলামী ব্যাংকের কর্মধারাও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। স্বতন্ত্র লক্ষ্য ও অনন্য কর্মকৌশলের মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত শক্তির প্রকাশ ঘটে এবং শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় ফুটে ওঠে। ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক কয়েকটি দিক এখানে প্রচলিত ধারার ব্যাংক ব্যবস্থার সাথে তুলনামূলকভাবে আলোচনা করা হলো ।

 

 

৬.১. ব্যক্তিস্বার্থ নয়, সামাজিক কল্যাণের আদর্শ

 

ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক কর্মকাণ্ডে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়ভিত্তিক একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক কাজ করে। ব্যক্তিস্বার্থ নয়, সামাজিক কল্যাণ ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের মূল কথা। শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা ইসলামী ব্যাংকের আদর্শ। শুধু আয়ের সৃষ্টি নয়, সে আয়ের সুষম বণ্টনের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম নীতি। ইসলামী ব্যাংকের এ নীতির মূলে রয়েছে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ, “…যাতে করে ধনসম্পদ শুধু বিত্তবানদের মধ্যে পুঞ্জীভূত না থাকে (আবর্তিত না হয়)।” (সূরা হাশর : ৭)

 

ইসলামী ব্যাংক সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মেধা ও কর্মক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তাদেরকে উৎপাদনে জড়িত করে। তাদের জন্য আয়-রোজগারে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে যেকোন মূল্যে মুনাফা অর্জন ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করাই সুদভিত্তিক ব্যবস্থার সারকথা ।

 

৬.২. সামাজিক উন্নয়নের সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমন্বয়

 

ইসলামী ব্যাংক শুধু একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, ইসলামী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার সহায়ক একটি সামাজিক আন্দোলন। উন্নয়ন সম্পর্কে ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব ধারণা রয়েছে। প্রচলিত অর্থনৈতিক ধারণার তুলনায় তা ব্যাপকতর অর্থ বহন করে। ইসলামী ব্যাংক ‘উন্নয়ন’ বলতে শুধু মুষ্টিমেয় মানুষের উন্নয়ন মনে করে না। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও এ ব্যাংক মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন বলে গণ্য করে না। মানুষের সার্বিক উন্নয়ন এ ব্যাংকের আদর্শ। সেই উন্নয়ন মূল্যবোধ সমন্বিত, বহুমুখী ও গতিশীল। উন্নয়নের এই সমন্বিত লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমেই একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ নির্মাণ সম্ভব। এই লক্ষ্যেই ইসলামী ব্যাংক কাজ করে।

 

ইসলামী ব্যাংকের বিবেচনায় সামাজিক উন্নয়নই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি। সামাজিক উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ইসলামী ব্যাংক তাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের দুই ধারাকে সমন্বিত করতে চায়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক-এই উভয় পরিসরে এ ব্যাংক কাজ করে। ইসলামী ব্যাংক এভাবেই সামাজিক স্বার্থ ও ন্যায়বিচারের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে। অন্যদিকে সুদনির্ভর ব্যাংক ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তিগত মুনাফার প্রশ্নটিই শুধু বিবেচনা করে।

 

৬.৩. অর্থনীতিতে নৈতিক শৃঙ্খলার বিধান অনুসরণ

 

অর্থসম্পদের ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন ও আর্থ-সামাজিক সুবিচার কায়েম ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য। এ লক্ষ্য নির্ধারণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে মানবকল্যাণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে ইসলাম। এই নৈতিক বাধ্যবাধকতা বা নৈতিক শৃঙ্খলা ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের ভিত্তি। অন্যদিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থসম্পদ, মানব সম্পদ ও বস্তুগত সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নৈতিক শৃঙ্খলার বিধান অনুপস্থিত। ফলে অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা দেখা দেয়। সমাজে অনাচার ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এভাবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। অনেক পাশ্চাত্য

 

অর্থনীতিবিদও স্বীকার করেছেন যে, নৈতিকতাহীন অর্থনীতি অশান্ত সাগরের বুকে হালবিহীন জাহাজের মতই বিপন্ন।

 

ইসলামী ব্যবস্থার উদ্দেশ্য শুধু একটি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান কায়েম করা নয়, এটি মাধ্যম বটে। সামাজিক কল্যাণের আদর্শের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠাও এই ব্যবস্থার লক্ষ্য। ইসলামী অর্থনীতির নৈতিক বিধান অনুসরণ করে ইসলামী ব্যাংক তার আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। ইসলামী অর্থব্যবস্থার নৈতিক বিধানের সারকথা হলো ঃ

 

ক. সকল সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক আল্লাহ। মানুষ ট্রাস্টি হিসেবে আদেশ ও নিষেধের অনুবর্তী হয়ে সে সম্পদ অর্জন ও ব্যবহার করবে।

 

আল্লাহর মালিকানা সম্পর্কে কুরআন মজীদের ঘোষণা : “আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সমস্ত আল্লাহরই।(সূরা বাকারা : ২৮৪ )

 

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মালিকানা তো আল্লাহরই।”(সূরা হাদীদ : ১০)

 

“আল্লাহ-আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা তাঁরই।”(সূরা ইবরাহীম : ২)

 

“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা তাঁরই…”।(সূরা হজ্জ : ৬৪)

 

“… আসমান ও যমীনের স্বত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই।”(সূরা আলে ইমরান : ১৮০ )

 

“আর আমি তো চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী।”(সূরা কাসাস : ৫৮)

 

… যমীন তো আল্লাহরই। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাঁর উত্তরাধিকারী করেন…।”(সূরা আরাফ : ১২৮)

 

আল্লাহর মালিকানা আসলে মানুষেরই জন্য। ‘সৃষ্ট জীবে’র মধ্যে সুষম বণ্টনের মাধ্যমে কল্যাণের লক্ষ্যে “তিনি পৃথিবী স্থাপন করেছেন সৃষ্ট জীবের জন্য ।”(সূরা রাহমান : ১০)

 

“তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন…..। (সূরা বাকারা : ২৯)

 

 

খ. মানুষ সম্পদ ব্যবহার করবে ইহকালীন ও পরকালী সন্ এবং ‘ফালাহ’ বা কল্যাণকে আহরণ করার জন্য। সম্পদের ব্যয় ও ব্যবহার সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে

 

“… আর আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন, তা থেকে হায় করো (শরীয়ার বিধান অনুসারে)।… (সূরা হ এই আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (র) বলেছেন, আল্লাহই নিরঙ্কুশ মালিক এবং বান্দার শুধু বায় ব্যবহারের অধিকার “তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও।”(সূরা বাকারা : ৪৩)

 “তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও।”(সূরা বাকারা : ১১০)

 

পথ নির্দেশ ও সুসংবাদ মুমিনদের জন্য যারা সালাত কায়েম করে। এবং যাকাত দেয়….।” (সূরা নামল : ২-৩)

 

“হে মুমিনগণ, আমি যা তোমাদের দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় কর।”(সূরা বাকারা : ২৫৪ )

 

 

“…আল্লাহ তোমাদের যে সম্পদ দিয়েছেন, তা থেকে তোমরা তাদেরকে দান করবে…

(সূরা নূর : ৩৩)

 

 

“হে মুমিনগণ, তোমরা যা উপার্জন করো এবং আমি যা ভূমি থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই, তার মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর…।”(সূরা বাকারা : ২৬৭)

 

“আল্লাহ যা কিছু তোমাকে দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান করো…।” (সূরা কাসাস : ৭৭)

 

“… আর ফসল তোলার দিন তার হক প্রদান করবে…(সূরা আনআম : ১৪১)

 

“তোমরা আল্লাহর পথে কেন ব্যয় করবে না?..” (সূরা হাদীদ : ১০)

 

“কে আছে যে আল্লাহ তা’আলাকে দেবে উত্তম ঋণ? …(সূরা হাদীদ ঃ ১১)

 

“তোমরা কখনো পুণ্য লাভ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা যা ভালবাসো তা থেকে ব্যয় না করো।…” (সূরা আলে ইমরান : ৯২)

 

“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো এবং নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।”(সূরা বাকারা : ১৯৫)

 

“আমি তোমাদের যে রিযক দিয়েছি, তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে তা থেকে ব্যয় করবে।”( সূরা মুনাফিকুন : ১০)

 

গুলোকে কি ব্যয় করবে সে সম্বন্ধে আপনাকে প্রশ্ন করে। বলুন যে, ধনসম্পদ তোমরা বায় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য।” (সূরা বাকারা : ২১৫)

 

গ. ‘আদল’ বা ন্যায়বিচার এবং ‘ইহসান’ বা দয়া প্রতিষ্ঠা ইসলামের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যম।

 

ইহসান এবং আদল বা ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন মজীদ ঃ

 

“হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ ……।”(সূরা নিসা : ১৩৫)

 

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকাজ পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে … (সূরা নিসা : ৫৮)

 

“নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা চুক্তি ভঙ্গকারীকে পছন্দ করেন না।”(সূরা আনফাল : ৫৮)

 

… আর যদি বিচার-নিষ্পত্তি কর, তবে তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালবাসেন।”( সূরা মায়িদা : ৪২)

 

“…আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুসারে যারা বিধান দেয় না, তারাই যালিম।”( সূরা মায়িদা : ৪৫)

 

…আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুসারে যারা বিধান দেয় না,তারাই ফাসিক।” (সূরা মায়িদা : ৪৭)

 “তারা বলবে, আমরা মুসল্লীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না, আমরা মিসকীনকে খাবার দান করতাম না।..” (সূরা মুদ্দাসসির : ৪৩-৪৪)

 

“…অতএব আপনি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হবেন না এবং প্রার্থীকে ভর্ৎসনা করবেন না।”(সূরা দুহা : ৯-১০)

 

“সে তো সে-ই, যে ইয়াতীমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং মিসকীনকে খাদ্য দানে উৎসাহ দেয় না।” (সূরা মাউন ঃ ২-৩)

 

“…সে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমানদার ছিল না এবং মিসকীনকে অনুদানে উৎসাহিত করতো না।” (সূরা হাক্কা ঃ ৩৩-৩৪)

 

এবং গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোট-খাট সাহায্যদানে বিরত থাকে। ” (সূরা মাউন)

 

“হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি, অন্যায়ভাবে স করো না; কিন্তু তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা করা বৈধ এবং একে অপরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু (সূরা নিসা : ২৯)

 

….এবং মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে।”(সূরা নিসা : ৩৬)

 

…সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা একে অপরের সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পর সাহায্য করবে না।”(সূরা মায়িদা : ২)

 

অর্থনৈতিক সুষম বণ্টন হবে আদল ও ইহসানের ধারায়। ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী ও অন্য ধর্মের অনুসারীরাও এর অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী অর্থনীতির বাস্তবায়নে প্রশাসন হবে সার্বজনীন পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে রয়েছে সর্বমানবিক দৃষ্টিকোণ ঃ

 

“আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে, তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দিবে।….(সূরা আন’আম : ১০৮)

 

“হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর…।”(সূরা মায়িদা : ৮)

 

মানবিকতা ও সততা সম্পর্কে রাসূল (সা)-এর বাণী ঃ

 

“বিধবা ও মিসকীনের সাহায্যের কাজে চেষ্টাকারী ও উদ্যোগ গ্রহণকারী এবং ব্যবস্থাকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদকারী ব্যক্তির সমমর্যাদাসম্পন্ন।”(বুখারী ও মুসলিম)

 

“সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীদের হাশর হবে সিদ্দীক ও শহীদদের সাথে। (তিরমিযী)

 

তারা ”’ যা কল্যাণমূলক ইনস্টিটিউশন কায়েম করবে এবং নিজেদের জীবনকে ‘মুনকার’ বা সকল বোঝা-বন্ধন ও কষ্ট-যাতনার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবে। মানুষের জীবনকে ভারমুক্ত ও সহজ করে কোলা ইসলামী ব্যবস্থার লক্ষ্য।

 

মাফ ও মুনকার সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে

 

“এই কুরআন মুত্তাকীদের জন্য অবশ্যই এক উপদেশ।”(সূরা হাক্কা ঃ ৪৮)

 

“এটা তো শুধু বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ।” (সূরা তাকভীর ঃ ২৭)

 

“তুমি মানুষকে তোমার প্রভুর দিকে আহবান জানাও হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে সংলাপ (মতবিনিময়) কর উত্তম পন্থায়।”(সূরা নাহল : ১২৫)

 

“অতএব আপনি উপদেশ দিন, আপনি তো একজন ..রাসূলগণের কর্তব্য তো কেবল সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছে দেওয়া।”(সূরা নাহল ঃ ৩৫)

 

“অতপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনার কর্তব্য তো কেবল স্পষ্টভাবে বাণী পৌঁছে দেওয়া।” (সূরা নাহল : ৮২)

 

“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান কর, অসৎ কাজে নিষেধ কর এবং বিশ্বাস কর।” (সূরা আলে ইমরান : ১১০)

 

“….তবে উপদেশ দেওয়া তাদের কর্তব্য যাতে তারাও তাকওয়া অবলম্বন করে।”(সূরা আনআম : ৬৯)

 

এ নৈতিক বিধানের আলোকে বিশ্ব-অর্থব্যবস্থাকে মানবীয় কল্যাণাদর্শের ভিত্তিতে পুনর্গঠনের জন্য ইসলামী ব্যাংক কাজ করছে। প্রচলিত সুদনির্ভর ব্যাংক ব্যবস্থা এই নৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ফলে তার পক্ষে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বিধান করা সম্ভব নয়। সুদভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা বাড়িয়ে তোলা ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধিতেই সহায়তা করছে ।

 

 

বিনিয়োগ কার্যক্রমে অংশীদারিত্বের নীতি

 

ইসলামী ব্যাংক মুশারাকা বা লাভ-লোকসান নীতির ভিত্তিতে। বিনিয়োগ করে। এ ধরনের ব্যবসায়ে লাভ হলে ব্যাংক তার অংশ পায়। লোকজান হলে তার অংশও ব্যাংক বহন করে। বর্তমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এবং ফাকিং ক্ষেত্রে এটি একটি বৈপ্লবিক চিন্তা। এর ফলে ব্যাংক গ্রাহকের সাথে একাত হয়ে ব্যবসায়ের উন্নতির জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালায়। এধরনের কাবাবে ব্যাংক গ্রাহকের সাফল্যকে তার নিজের সাফল্য মনে করে। গ্রাহকের ব্যর্থতার ব্যাংকের ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য হয়। গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যকার এই উন্নয়নমুখী কল্যাণধর্মী এ ব্যবস্থা প্রচলিত সুদনির্ভর পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

 

… টাকার কারবার নয়-পণ্যের ব্যবসা মুশারাকা পদ্ধতি ছাড়াও মুরাবাহা, বাই-মুয়াজ্জল, বাই-সালাম, ইজারা, ভাড়ায়। ক্রয় প্রভৃতি পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক বিনিয়োগ করে থাকে। সুদমুক্ত এসব পদ্ধতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, ব্যাংক কাউকে সরাসরি টাকা লগ্নি করে। না। পণ্যের মাধ্যমে ব্যাংক এসব বিনিয়োগ পরিচালনা করে। টাকা লগ্নি করে বিনিময়ে বাড়তি টাকা গ্রহণ সুদের মধ্যে গণ্য হয়। কিন্তু পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা যে অর্থ অর্জিত হয়, তা লাভ। টাকার নিজস্ব কোন উৎপাদন ক্ষমতা নাই। মানুষের কোন প্রয়োজনেই টাকা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে না। এটি একটি মাধ্যম, একটি পরিমাপ, একটি মানদণ্ড এবং একটি ভাণ্ডারের ভূমিকা পালন করে মাত্র। তাই ইসলাম অর্থকে পণ্য হিসেবে গণ্য করে না। টাকার বিনিময়ে টাকা বেশি বা কম গ্রহণ-প্রদানকেও ইসলাম অনুমোদন করে না।

 

সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আসল পরিচয় হলো, তারা টাকার ব্যবসায়ী। টাকাকেই তারা পণ্যের মতো বেচা-কেনা করে। তাদের এই কার্যক্রমকে সক্রেটিস আখ্যা দিয়েছেন ‘জালিয়াতি’। আর কার্ল মার্কস-এর ভাষায় এ ধরনের ব্যাংকাররা হলো ‘ডাকাত’, ‘সিঁদেল চোর’, ‘বিকট শয়তান’। ব্যাংকিং ব্যবসায়ের নামে পরিচালিত এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি ও চৌর্যবৃত্তির মূলোৎপাটনের জন্য ইসলামী ব্যাংক আপোসহীন যুদ্ধে লিপ্ত।

 

৬.৬. মুদ্রাস্ফীতির কারণ দূর করা

 

‘মুদ্রাস্ফীতি’ আধুনিক অর্থনীতির একটি প্রধান সমস্যা। মুদ্রাস্ফীতি সামাজিক সুবিচার ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার বিরোধী। অর্থের মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা তাই ইসলামের অর্থনৈতিক নীতিমালার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

প্রধান তিনটি কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে ক. অর্থের ক্রমবৃদ্ধির সাথে উৎপাদন প্রবৃদ্ধির অসামঞ্জস্য;

 

খ. অনুৎপাদনশীল ও অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় বৃদ্ধি: গ. সরকারী ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি

 

সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় পণ্যের সাথে টাকার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট হারে মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ঘটাতে পারে। ফলে মুদ্রার সামগ্রিক সোপান বেড়ে গিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। সুদনির্ভর অর্থলগ্নির ফলে বাজারে অর্থের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে অর্থ উৎপাদনে নিয়োজিত না হলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে বাধ্য।

 

ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম নানা উপায়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। প্রথমত ইসলামী ব্যাংক অর্থের লগ্নি করে না। পণ্যের বেচাকেনাই ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির মূল ভিত্তি। উৎপাদনের সাথে এ পণ্য প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। পণ্যভিত্তিক এই বিনিয়োগ কার্যক্রমের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির কারণ দূর হয়। লগ্নিকৃত টাকা অনেক সময় নির্ধারিত খাতের বাইরে সরিয়ে নেয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এর ফলে ব্যাংকের ঋণ প্রদানের উৎপাদনমূলক লক্ষ্য ব্যাহত হতে বাধ্য। পণ্যভিত্তিক বিনিয়োগ এ ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।

 

দ্বিতীয়ত ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় অত্যাবশ্যকীয়, উৎপাদনমূলক, শ্রমের সাথে যুক্ত, সামাজিকভাবে লাভজনক এবং বৈধ খাতে বিনিয়োগ করা হয়। এ বিনিয়োগনীতি সমাজের মানুষের চাহিদার সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। এ নীতি মুদ্রাস্ফীতির সবক’টি কারণ দূর করতে সহায়তা করে ।

 

তৃতীয়ত ইসলামী ব্যাংক মানুষকে শুধু ব্যাংকিং-এর প্রতি আকৃষ্ট করে না, সামাজিক দায়িত্ব পালনেও তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম সমাজে অবৈধ আয়কে নিরুৎসাহিত করে। সম্পদের সুবিচারমূলক বণ্টন এবং ন্যায়নিষ্ঠ লেনদেনের সুযোগ প্রসারিত করে। ইসলামী ব্যবস্থায় নৈতিক শৃংখলার নীতি প্রাধান্য পায়। ফলে সম্পদের অপরিমিত ব্যবহার ও অপচয় নিরুৎসাহিত হয়। এ ব্যবস্থা কার্যকরী হবার ফলে অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হ্রাস পায়। বর্ধিত সরকারী ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনও কমে আসে।

 

 

.. বেকারত্ব দূরীকরণ ও অধিক কর্মসংস্থান

 

ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য, নীতি ও কার্যক্রম সামগ্রিকভাবে উৎপাদনের সাথে যুক্ত। উৎপাদনমূলক কার্যক্রম কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্ত করে। ইসলামী ব্যাংক শুধু সম্পদশালী লোকদের মাঝে তার বিনিয়োগ সীমিত রাখে না। সমাজের স্বল্পবিত্ত ও বিত্তহীন লোকদের কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকল্প ও উদ্যোগ গ্রহণ করে। এটি ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের একটি অপরিহার্য কর্মকৌশল ।

 

অন্যদিকে কর্মসংস্থানে সুদের ভূমিকা নেতিবাচক। কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করতে সুদ শক্তিশালী উপাদানরূপে কাজ করে। সুদের পূর্ণ কর্মসংস্থানের স্তরে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে সমতা রাখতে বাধ্য হয়। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা এ দোষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। বেকারত্ব দূরীকরণে অধিক কর্মসংস্থানে ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা ইতিবাচক, প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়। সম্পদ সৃষ্টি ও বণ্টনে জনকল্যাণের আদর্শ ইতিবাচক হার

 

.. সঞ্চয় সংগ্রহ এবং তা বিনিয়োগের ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংকের নীতি ও কর্মপন্থা সুদভিত্তিক ব্যাংক থেকে আলাদা। জনগণের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করে তা তাদেরই ভাগ্যোন্নয়নের কাজে খাটানো ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ নীতি ইসলামী ব্যাংকের আর্থ-সামাজিক লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অন্যদিকে অর্থলগ্নির মাধ্যমে সম্পদ কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যেই সুদভিত্তিক ব্যাংকের জন্ম। ফলে প্রধানত অর্থশালী লোকেরাই সুদভিত্তিক ব্যাংকের কার্যক্রমের আওতাভুক্ত। আবার বিত্তবান সকল লোকের গুরুত্ব এসব ব্যাংকের কাছে সমান নয়। সুদভিত্তিক ব্যাংকের নজার বড় বড় সঞ্চয়ের প্রতি নিবন্ধ। কমসংখ্যক লোকের কাছ থেকে বেশি সঞ্চয় সংগ্রহ করা তাদের কাছে বেশি। লাভজনক ও কম ঝামেলাপূর্ণ। এসব সঞ্চয়কারীর টাকা লগ্নি করা হয় অধিকতর সম্পদশালী মুষ্টিমেয় লোকদের মাঝে। তেলা মাথায় তেল দেয়াই। তাদের এ কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য । এটাই তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুবিধাজনক। এভাবে সুদভিত্তিক ব্যবস্থা সমাজের অর্থ-সম্পদ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত করার একটি প্রক্রিয়ারূপে কাজ করে। এ প্রক্রিয়ায় সমাজে ধনবৈষম্য বেড়ে যায়, সামাজিক ভারসাম্য ভেঙ্গে পড়ে।

 

ইসলামী ব্যাংকের অবস্থা এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ব্যাংক সমাজের সার্বিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করে থাকে। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ব্যাংক তার কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করে এবং জনগণকে ইসলামী সঞ্চয় নীতির প্রতি আকৃষ্ট করাই বেশি জরুরি গণ্য করে।

 

ইসলাম অর্থের মজুদ বৃদ্ধি নিরুৎসাহিত করেছে, কিন্তু সঞ্চয় সৃষ্টি করে তা উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত করতে উৎসাহ দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক তাই জনগণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংগ্রহ করে তা নিজস্ব পদ্ধতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখে। এসব ক্ষুদ্র আমানত গ্রহণের ফলে হিসাব রক্ষা সংক্রান্ত কাজের চাপ এবং প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তা সত্ত্বেও এ সঞ্চয়নীতি অনুসরণকে ইসলামী ব্যাংক সমাজের জন্য লাভজনক এবং ব্যাংকের আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য অপরিহার্য বিবেচনা করে। স সংগঠন-প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশীদার ইসলামী ব্যাংক জাতির প্রতিটি সদস্যকে সঞ্চয়ের কাজে অভ্যস্ত করে তুলতে আন্তরিকভাবে আগ্রহী। সঞ্চয়ের এ অভ্যাসকে ইসলামী ব্যাংক সমাজের সকল সদস্যের মজ্জাগত অভ্যাসরূপে গড়ে তুলতে চায়। সমাজে সঞ্চয়ের অভ্যাস বাড়লে সম্পদ সৃষ্টির জন্য তা সহায়ক হবে, আর সম্পদ সৃষ্টির সফলতার উপরই দেশের সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। সমাজে সঞ্চয়ের অভ্যাস যত বেশি হবে, তা সম্পদ তৈরিতেও সহায়ক হবে। সমাজে ইসলামের দাবি পূরণে সমর্থ লোকদের সংখ্যাও সে অনুপাতে বেড়ে যাবে।

 

ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য শুধু সম্পদ তৈরিতে সাহায্য করা নয়, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করাও ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। অন্যথায় সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে তা সমাজে বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতাকে প্রকট করে তুলবে। ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সে উৎপাদনের সুষম বণ্টনের সাথে যুক্ত। এ প্রক্রিয়া জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং সে আয়ের বণ্টন নিশ্চিত করার সহায়ক। জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কুক্ষিগত না করে স্বল্পবিত্ত এবং বিত্তহীনদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া ইসলামী ব্যাংকের আদর্শ। এভাবে উৎপাদনক্ষম জনশক্তির সাথে বিনিয়োগের সম্মিলন ঘটিয়ে সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্তিশালী করা সম্ভব। এ নীতি সামাজিক ন্যায়বিচার এবং দেশের প্রকৃত উন্নতি ও সমৃদ্ধির সহায়ক। ইসলামী ব্যাংকের নীতি হলো অল্প টাকা বেশি লোকের কল্যাণে নিয়োজিত করা। অন্যদিকে বেশি লোকের টাকা অল্প লোকের স্বার্থে ব্যবহার করা সুদভিত্তিক ব্যাংকের লক্ষ্য।

 

###গ্রাহকদের সাথে অংশীদারিত্বের সম্পর্ক

 

সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থায় সঞ্চয়কারী, ব্যাংকার ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নৈর্ব্যক্তিক। ঋণগ্রহীতার ব্যবসায়িক লাভক্ষতির অবস্থা যাই হোক, সুদের হার পূর্বনির্ধারিত। তার লাভক্ষতির সাথে ব্যাংকের স্বার্থ জড়িত নয়। সঞ্চয়কারীর সুদের হারও পূর্বনির্ধারিত। ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রমের ভালোমন্দের সাথে তার লাভ-ক্ষতির কোন সম্পর্ক নেই।

 

এভাবে দেখা যায়, এ ব্যবস্থায় কোন পক্ষই অন্যের ভালোমন্দের সাথে যুক্ত নয়। কেউ কারো দায়িত্ব বহন করেন না। সকল পক্ষ পূর্বনির্ধারিত সুদ গ্রহণ বা প্রদান করার কারণে তাদের মাঝে পারস্পরিক সমস্বার্থবোধ বা একাত্মতা গড়ে ওঠার সুযোগ থাকে না।

 

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সঞ্চয়কারীদের লাভ-লোকসান ব্যাংকের লাভ- লোকসানের সাথে যুক্ত। আবার ব্যাংকের লাভ-লোকসান বিনিয়োগগ্রহীতাদের ব্যবসায়িক ফলাফলের উপর নির্ভরশীল। ফলে এক্ষেত্রে সঞ্চয়কারী, ব্যাংকার ও বিনিয়োগ-গ্রহীতা পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ। এখানে পারস্পরিক সম্পর্ক অংশীদারিত্বের, দাতা-গ্রহীতার নয়। তাই ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় সকল পক্ষ তাদের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে সমন্বিত করে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হন। গ্রাহক সম্পৃক্ততার এই আদর্শ ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম প্রধান শক্তিরূপে বিবেচিত।

 

৬.১০. শ‍রীয়ার নীতি অনুসরণ

আর্থিকভাবে লাভজনক কোন ব্যবসা সামাজিক বিবেচনায় অকল্যাণকর হসে ইসলামী ব্যাংক তাতে অংশ নেয় না। শরীয়ার দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ কোন পাতে লেনদেন থেকে এ ব্যাংক বিরত থাকে। ইসলামী ব্যাংক টাকার ব্যবসা করে না, পণ্যের কারবারে নিয়োজিত থাকে।

 

শরীয়ার আল-ওয়াদিয়া নীতির ভিত্তিতে চলতি হিসাব পরিচালিত হয়। লাভ- লোকসান অংশীদারী জমা হিসাব (সঞ্চয়ী হিসাবের বিকল্প) ও লাভ-লোকসান অংশীদারী মেয়াদী জমা হিসাব (স্থায়ী জমা হিসাবের বিকল্প) পরিচালিত হয়। মুদারাবা নীতির ভিত্তিতে। ইসলামী ব্যাংক তার বিনিয়োগ কার্যক্রমে শরীয়ার মুদারাবা, মুশারাকা, মুরাবাহা, বাই-মুয়াজ্জাল, বাই-সালাম, শিরকাত-উল- মিলক প্রভৃতি নীতি অনুসরণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সুদভিত্তিক অন্যান্য ব্যাংকের সাথে এমনকি আন্তর্জাতিক সুদভিত্তিক ব্যাংকসমূহের সাথে লেনদেনেও ইসলামী ব্যাংক সুদ পরিহার করে। জনগণকে ব্যাংকিং লেনদেনে ইসলামী শরীয়ার নীতি অনুসরণে ইসলামী ব্যাংক উদ্বুদ্ধ ও সাহায্য করে।

 

ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম শরীয়ার বিধান মুতাবেক পরিচালিত হচ্ছে কি না তা তদারক করার জন্য রয়েছে শরীয়াহ্ কাউন্সিল। প্রখ্যাত আলিম, ফকীহ, অর্থনীতিবিদ ও আইনজীবীগণের সমন্বয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এই শরীয়াহ কাউন্সিল গঠন করা হয়। বিশ্বের প্রতিটি ইসলামী ব্যাংক শরীয়াহ্ কাউন্সিলের তদারকির অধীন।

 

ব্যাংকের সকল প্রকার চুক্তি সম্পাদন ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে পূর্বাহে শরীয়াহ্ কাউন্সিলের অনুমোদন নিতে হয়। শরীয়াহ্ কাউন্সিল ব্যাংকের সকল কার্যক্রমে ইসলামী শরীয়াহ্ সংক্রান্ত যথার্থতা তদারক করে এবং এ ব্যাপারে নিয়মিত পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করে। ইসলামী ব্যাংক শরীয়ার নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য শরীয়াহ্ কাউন্সিল সরাসরিভাবে নিরীক্ষা কার্যক্রম (অডিট) পরিচালনা করে। সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে প্রথমত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিজস্ব অডিট টীম নিরীক্ষা পরিচালনা করে। দ্বিতীয়ত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার অডিট টীমের মাধ্যমে নিরীক্ষা দু’ধরনের অডিটের অতিরিক্ত ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রমে সুদ অন্য কোন হারাম উপাদান যুক্ত হয়েছে কি না, অথবা ব্যাংকের লাভের সাথে কোন মা কোনভাবে সুদ বা সন্দেহজনক আয়ের সংমিশ্রণ ঘটেছে কি না, শরীয়াহ কাউন্সিল তীক্ষ্ণভাবে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে। শরীয়াহ্ কাউন্সিলের প্রত্যয়নপত্র ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে পারে না। সংবিধিবদ্ধ নিরীক্ষকদের প্রতিবেদনের পাশাপাশি তাদের প্রত্যয়নপত্র বার্ষিক প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত থাকে ।

 

শরীয়ার মূলনীতিসমূহ মানুষের স্রষ্টা ও প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উৎসারিত। ফলে এ ব্যবস্থা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও জৈবিক চাহিদার সাথে পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ এবং মানুষের পারস্পরিক আর্থ-সামাজিক আচরণের ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা বিধানে পূর্ণরূপে সক্ষম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। অন্যদিকে সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থার জন্ম ও বিকাশ ঘটেছে মানব-মস্তিস্ক-প্রসূত ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তার ভিত্তিতে, যেখানে এক দল কর্তৃক আরেক গোষ্ঠীকে শোষণের ফন্দি উদ্ভাবনই কাজ করছে মূল চেতনারূপে।

 

৬. ১১. বঞ্চিত ও অভাবী মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন

 

ইসলামী ব্যাংক সমাজবিচ্ছিন্ন কোন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে ভাবার উর্ধ্বে। সমাজের সাথে সুদৃঢ় সংযোগ-সম্পর্ক রক্ষা করে সমাজ কল্যাণের উদ্দেশ্যে সমাজের অভাবী লোকদের আর্থিক উন্নতির প্রতিও ইসলামী ব্যাংক বিশেষ মনোযোগী। জনগণের অব্যাহত উন্নতি ও সামাজিক সাম্য অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক বিভিন্নমুখী পরিকল্পিত জনকল্যাণমূলক কাজ করে থাকে।

 

এ উদ্দেশ্যে সাধারণত যাকাত ও সাধারণ দানের অর্থে পৃথক হিসাবের ভিত্তিতে ব্যাংকের জনকল্যাণমূলক তহবিল গঠিত হয়। এ ধরনের জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমকে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দেয়। আল-কুরআনে বলা হয়েছে ঃ

 

“তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও…।”(সূরা বাকারা : ৪৩)

 

“কিন্তু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য যে যাকাত তোমরা দিয়ে থাকো তা-ই বৃদ্ধি পায়; তারাই সমৃদ্ধিশালী।”(সূরা রূম : ৩৯)

 

“যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের কষ্টদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।” (সূরা তওবা : ৩৪)

 

… লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কি তারা ব্যয় করবে? বলুন, যা উদ্বৃত্ত।”(সূরা বাকারা : ২১৯)

 

“তা ধনী লোকদের নিকট থেকে আদায় ও গ্রহণ করা হবে এবং তা সেই সমাজেরই দরিদ্র লোকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। (বুখারী)

 

আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন “রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান। তুমি (আমার অভাগা বান্দাদের জন্য) খরচ কর। আমি তোমার ওপর খরচ করবো।” (বুখারী, মুসলিম)

 

ইসলামী ব্যাংকের এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতিয়ারে রূপান্তরের পক্ষে খুবই সহায়ক। অভাবী অধ্য যোগ্যতাসম্পন্ন পরিবারগুলো যাতে স্থায়ী ও স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে-এ তহবিলের অর্থ প্রধানত সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ব্যয় করা হয়।

 

অতি দারিদ্র্য পীড়িত আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে সীমিত সংখ্যক শাখা নিয়ে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো গত কয়েক বছরে জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সমাজের নিঃস্ব ও বঞ্চিত মানুষের মাঝে তাদের এ কার্যক্রমের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এদেশের সার্বিক ব্যাংকব্যবস্থা ইসলামের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত হলে এবং হাজার হাজার শাখা নিয়ে গঠিত এদেশের বিরাট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক দেশের অভাবী মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত ও নিবেদিত হলে দেশের আর্থ-সামাজিক দেহ থেকে অসুস্থতার সকল চিহ্ন খুবই দ্রুত মুছে ফেলা সম্ভব, এটা বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম থেকে স্পষ্ট।

 

সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর এ ধরনের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী নেই। ব্যাংকিং লেনদেনের আওতাবহির্ভূত সমাজের সিংহভাগ মানুষের সাথে সংযোগ- সম্পর্ক রক্ষা বা তাদের প্রতি কোনরূপ দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন তারা অনুভব করে না।

 

উপরের এই সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আদর্শ, নীতি, পদ্ধতি, কর্মকৌশল ও কর্মধারার যেকোন বিবেচনায়ই ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা অন্য যেকোন ব্যাংক-ব্যবস্থার তুলনায় শ্রেষ্ঠ। ইসলামী থাকে ন্যায়ানুন, সুষম, ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এই হাতিয়ারটি অধিকতর দক্ষতার গুণের অধিকারী। ইসলামী ব্যাংক স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার সমন্বয় সাধনে সক্ষম উদার বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ব্যবস্থা।

 

আধুনিককালের জাতিসংঘ সনদ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সনদে উন্নয়ন বলতে একটু ভালো থাকার সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে ‘মানস জগতের উন্নতি’—সমন্বিত যে সার্বিক উন্নতির ধারণা পেশ করা হয়েছে, তা কেবলমাত্র ইসলামের উন্নয়ন ধারণারই নিকটবর্তী। ইসলাম ব্যক্তির ওপর সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব আরোপ করেছে। কিন্তু ব্যক্তির উৎকর্ষের সাথে সামাজিক অনুশাসনের সংযোগ সাধন করে ভারসাম্য ও শৃংখলার বিধান আরোপ করেছে; যা সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। মানুষ তার অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের নীতিকে নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত না করলে ভারসাম্যহীনতা ও অস্থিতিশীলতা দূর করা যাবে না। ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা নৈতিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠার সেই “ফিল্টার মেকানিজম’ প্রয়োগ করছে।

 

পুঁজিবাদী ব্যাংক ব্যবস্থার মোটিভেশনের মূল কথা হলো, ব্যক্তিস্বার্থই ব্যক্তিকে সর্বাধিক দক্ষভাবে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যদিকে ইসলামের মোটিভেশন হলো, মানুষের লক্ষ্য হতে হবে শুধু এ পৃথিবীতে তার অবস্থা ভালো করা নয়; বরং পরকালীন জীবনকে সুন্দর করার মধ্যেও তার ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত। সামাজিক স্বার্থ বিঘ্নিত করে ব্যক্তিস্বার্থ অর্জন করা ইসলামের দৃষ্টিতে সীমা লংঘনের পর্যায়ভুক্ত।

 

“ঈমান আনো আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের প্রতি। আর ব্যয় করো সেই ধনসম্পদ থেকে, যাতে তিনি তোমাদের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেছেন।(সূরা হাদীদ ঃ ৭-৮)

 

আল-কুরআনের উক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (র) বলেন, আল্লাহই নিরঙ্কুশ মালিক এবং বান্দার শুধু ব্যয় ব্যবহারে অধিকার। আল্লাহ্র মালিকানা, মানুষের আমানাতদারী ও প্রতিনিধিত্ব এবং সমাজকল্যাণে কার্য পরিচালনাই এ বিধানের বার্তা।

 

এ প্রসঙ্গে আলোকনোভ বলেছেন, যে সমাজ শুধু মুনাফা নিয়ে ব্যস্ত, তার পতন ঘটবে। অর্থই সাফল্যের একমাত্র নিয়ামক বিবেচিত হলে সে সমাজে দুর্নীতি বহু গুণে বেড়ে যাবে ।

 

যোশেফ সুমপিটার বলেছেন, প্রতিটি মানুষ যদি তার একপেশে স্বল্পমেয়দী  স্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত হয়, তবে কোন সমাজই চলতে পারে না। সন্দেহ নেই, মানবরচিত মতবাদসমূহ বিশ্বমানবতাকে এক অচলায়তনে বন্দী

 

করে রেখেছে। ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা সেসব সনাতনী ধ্যান-ধারণার ভিত্তিমূলে আঘাত করে বৈপ্লবিক চিন্তা উপস্থিত করেছে। এ ধারণা আধুনিক বিশ্বের মানসজগতে আলোড়ন ও বিপ্লব সৃষ্টি করতে সক্ষম। বস্তুত মানুষের যিনি স্রষ্টা ও প্রতিপালক, ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা তাঁর বিধান থেকেই উৎসারিত। সে কারণে এ ব্যবস্থা মানবীয় চিন্তার অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত। ইসলামী ব্যাংক তার সম্পূর্ণতা ও সম্পন্নতা নিয়ে মাত্র আড়াই দশকের মধ্যে বিশ্ব অর্থবাজারে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সার্বিক অর্থনৈতিক ধারায় তার ইতিবাচক ও সহায়ক অবস্থানকে সংহত করে নিতে সক্ষম হয়েছে। অতি অল্প সময়ে ইসলামী ব্যাংক- ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়েছে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বল্প মূলধনী দেশগুলোতে, মিসর ও সুদানে এবং তার পাশে আফ্রিকার শৃঙ্গবর্তী দেশসমূহে এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের রাজধানী বলে কথিত ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি এলাকায়। যেকোন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ইসলামী ব্যাংক কাজ করতে সক্ষম-এই আন্তর্জাতিক উপযোগিতা প্রমাণে এ ব্যবস্থা ইতোমধ্যে সমর্থ হয়েছে। গত কয়েক দশকের উপর্যুপরি অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও উপসাগরীয় অঞ্চলের ইসলামী ব্যাংকসমূহের কার্যক্রম সর্বত্র বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রচলিত পদ্ধতির ব্যাংকসমূহের তুলনায় অধিকতর পারদর্শিতা দেখিয়েছে।

 

এশীয় দেশসমূহের মধ্যে পাকিস্তান ও ইরান নিজ নিজ দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ইসলামী শরীয়ার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করে প্রমাণ করেছে যে, একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও ব্যাংক-ব্যবস্থা ইসলামী নীতির মাধ্যমে পরিচালনা করা এবং জনগণের কাছে অধিকতর সুফল পৌঁছে দেয়া সম্ভব। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতার পটভূমিতে আজ একথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়, একুশ শতকের পৃথিবী ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থাকে সাগ্রহে বরণ করে নিয়েছে।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *