বায় মুআজ্জাল বা বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়

বায়মুআজ্জাল বা বাকিতে ক্রয়বিক্রয় (Investment Method of Bai Muazzal)

বায়’ মু’আজ্জাল ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমে বহুল ব্যবহৃত একটি শরী’আহ সম্মত বিনিয়োগ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক ক্রেতার পরমায়েশ অনুযায়ী পন্যের উপর মালিকানা অর্জনের পর ক্রেতার কাছে বাকিতে পণ্য বিক্রয় করে। এক্ষেত্রে ক্রেতা- বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিক্রমেই ক্রয়মূল্যের উপর অতিরিক্ত মূল্য ধার্য করে বিক্রয় চুক্তি সম্পাদিত হয় ।

 

বায়মুআজ্জাল পরিচিতি(Introduction of Bai – Muazzal )

মু’আজ্জাল একটি আরবি শব্দ। এটা মূলত আজল  উদ্ভূত।

 

আজল শব্দের আভিধানিক অর্থ বিলম্ব, বাকি, সময় পিছিয়ে দেয়া, ভবিষ্যতের নির্ধারিত সময় বা মেয়াদ অর্থাৎ বিলম্বে প্রাপ্য প্রদান করা। আর মু’আজ্জাল মানে বিলম্বিত, বিলম্বে পরিশোধযোগ্য, বাকি, নগদের বিপরীতে ক্রয়-বিক্রয়, নির্ধারিত সময়ে দাম পরিশোধ করার শর্তে বাকিতে বিক্রয়। বায়’ অর্থ বেচা-কেনা, ক্রয়-বিক্রয়। বায়’ মু’আজ্জাল অর্থ তাই বিলম্বে পরিশোধ। বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করাকে বায়’ মু’আজ্জাল বলা হয়।

 

১. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রকাশিত ম্যানুয়াল ফর ইনভেস্টমেন্টে আন্ডার বায়’ মু’আজ্জাল মোড-এ বলা হয়েছে, বায়’ মু’আজ্জাল বলতে ব্যাংক কর্তৃক মুনাফার উদ্দেশ্যে গ্রাহকের নিকট বাকিতে মাল বিক্রয় বুঝায়। ব্যাংক পণ্য কিনে তার উপর মালিকানা নিশ্চিত করার পর চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গ্রাহককে সম্মত মূল্যে সেই পণ্য সরবরাহ করে। চুক্তিতে পণ্যের ধরন, মান, পরিমাণ, বিক্রয়মূল্য, পণ্য সরবরাহের স্থান ও সময়, দাম পরিশোধের সময়সীমা ও পদ্ধতি ইত্যাদি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকে ।

 

২. ‘সেন্ট্রাল শরীয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ’ কর্তৃক প্রণীত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত ‘ইসলামী ব্যাংক কোম্পানী আইন’ এ (প্রস্তাবিত) ‘বায়’ মু’আজ্জাল’-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘বায়’ মু’আজ্জাল বলতে ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে সম্পাদিত এমন এক বিক্রয় চুক্তিকে বুঝাবে, যেখানে গ্রাহকের ফরমায়েশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোনো পণ্য উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত মূল্যে গ্রাহকের নিকট বাকিতে বিক্রয় করা হবে। এ চুক্তিতে ব্যাংক গ্রাহকের কাছে পণ্যের প্রকৃত ক্রয়মূল্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয়।

 

৩. ড. এম. উমর চাপরার মতে, (Bai muazzal refers to sale against deffered payment either in lumpsum or instalments). অর্থাৎ, “ভবিষ্যতের নির্ধারিত কোনো সময়ে, এক সাথে অথবা নির্ধারিত কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করার শর্তে পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করাকে বায়’ মু’আজ্জাল পদ্ধতি বলা হয়।” নগদ বিক্রয়কালে পণ্যের যে দাম নেয়া হয়, বায়’ মু’আজ্জাল পদ্ধতিতে বিক্রয় কালে তার চেয়ে কম দামে বা বেশি দামে পণ্য বিক্রয় করা যেতে পারে।

 

৪. ড. এম. এ হামিদের মতে, “Bai-Muazzal means sales on deferred payments. Under this mode, the bank buys the goods needed by the clients, adds profit on it on mutual consultation and hands over the goods to them. The clients pay back the money either at a time or by instalments.” অর্থাৎ, ‘বায়’ মু’আজ্জাল অর্থ বিলম্বে পরিশোধ। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক গ্রাহকের অনুরোধে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করে এবং পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে মুনাফা নির্ধারণ করে মূল্যের সাথে যুক্ত করে তার কাছে ঐ দ্রব্যসামগ্রী হস্তান্তর করে। স্বীকৃত চুক্তি অনুসারে গ্রাহক দ্রব্যসামগ্রীর দাম নির্দিষ্ট সময়ের পর কিস্তিতে অথবা এককালীন পরিশোধ করে থাকে।

 

৫. আলী হায়দার আমীন আফিন্দির মতে, “বায়’ মুআজ্জাল হলো এমন এক ধরনের ক্রয়-বিক্রয় যাতে পণ্যটি নগদে ও মূল্য বাকিতে পরিশোধ করা হয়।

 

৬. আবদুর রকীব-এর মতে, “ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোনো সময়ে একসাথে অথবা নির্ধারিত কিস্তিতে সম্মত মূল্য পরিশোধের শর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরী’আহ্ অনুমোদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করাকে বায়’ মু’আজ্জাল বলে ।

 

৭. ড. মাহফুজুর রহমান লিখেছেন, “পণ্যের মূল্য নগদ পরিশোধ না করে বাকিতে পরিশোধ করার কারণে ক্রয়-বিক্রয়টি ‘বায়’ মু’আজ্জাল’ বা ‘বাকি ক্রয়-বিক্রয়’।

 

সর্বোপরি, বায়’ মু’আজ্জাল হচ্ছে সে ধরনের বিক্রয় যেখানে কোনো নির্দিষ্ট সময় পর মূল্য পরিশোধ হবে। বিক্রয় যখন বাকিতে হয় তখনই তা হয় বায়’ মু’আজ্জাল । বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় করাকে বায়’ মু’আজ্জাল বলা হয়। এটি এমন একটি পণ্য বিক্রয় চুক্তি মূল্য পরিশোধ পরে করতে হয়।

 

ইসলামী শরীআহর দলিল(Evidence of Islamic Shariyah)

বায়’ মু’আজ্জাল বাকিতে বিক্রয় পদ্ধতি। আর এই বাকি বিক্রি ইসলামে বৈধ বলে ঘোষিত হয়েছে, এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। এ পদ্ধতির ক্রয়-বিক্রয় এ কারণেই বৈধ যে, আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

 

وَاحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا

 

অর্থাৎ, “আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় বা বেচা-কেনাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে অবৈধ করেছেন।

 

এ আয়াতে সকল প্রকার বেচাকেনা তা নগদ হোক, বাকি কিংবা অগ্রিম হোক সবই বৈধ করা হয়েছে। যেহেতু বায়’ মু’আজ্জাল একটি বিক্রয় পদ্ধতি সুতরাং তা এ আয়াতের আলোকে বৈধ। এ পদ্ধতির ক্রয়-বিক্রয় এ কারণেও বৈধ যে, মহানবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবীগণ পরস্পরের সাথে এ পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয় করেছেন। এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত কতিপয় হাদীস নিম্নরূপ :

 

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ! إِنَّ فُلاناً قَدِمَ لَهُ بَةٌ مِنَ الشَّامِ فَلَوْ بَعَثْتَ إِلَيْهِ فَأَخَذْتَ مِنْهُ ثَوْبَيْنِ بِنَسِيئَةٍ إِلَى مَيْسَرَةٍ فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ, فَامْتَنَعَ

 

অর্থাৎ, “হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল (সা.) অমুক এসেছে। তার কাছে (বিক্রয়ের জন্য) সিরিয়ার কিছু কাপড় আছে। আপনি যদি তার কাছে কাউকে পাঠাতেন অতঃপর সচ্ছল হবার পর মূল্য আদায় করার কথা দিয়ে বাকিতে দু’টি কাপড় ক্রয় করতেন (তাহলে ভালো হতো)। একথা শুনে মহানবী (সা.) একজন সাহাবীকে তার কাছে পাঠালেন; কিন্তু লোকটি বাকিতে বিক্রয় করতে অস্বীকার করল।

 

রাসূল (সা.)-এর বাকিতে পণ্য ক্রয় করতে চাওয়া থেকে তা বৈধ বলে প্রমাণিত হয়।

 

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ : اشْتَرَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ

 

يَهُودِي طَعَامًا بِنَسِيئَةٍ، وَرَهَنَهُ دِرْعَهُ

অর্থাৎ, “হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) হতে অপর এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, “মহানবী (স) জনৈক ইহুদির কাছ থেকে কিছু খাদ্য বাকিতে ক্রয় করেছিলেন এবং তার কাছে একটি লৌহ বর্ম বন্ধক রেখেছিলেন।

 

عَن صَالِحِ بْنِ صُهَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ثَلَاثُ فِيهِنَّ الْبَرَكَةُ الْبَيْعُ إِلَى أَجَلٍ وَالْمُقَارَضَةُ، وَأَخْلَاطُ الْبُرِ بِالشَّعِيرِ

 

لِلبَيْتِ لا للبيع

 

অর্থাৎ, “হযরত সুহাইব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, “মহানবী (স) বলেছেন তিনটি জিনিসের মধ্যে বরকত রয়েছে। আল বায়’ইলা আজাল (বাকি ক্রয়-বিক্রয়), মুকারাদা (মুদারাবা) ও বাড়িতে খাবার জন্য, ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নয়, গমের সাথে যব মিশানো।”

 

উপরিউক্ত হাদীসগুলো হতে প্রমাণ হয় যে, বাকিতে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা ইসলামে বৈধ। শেষোক্ত হাদীস হতে জানা যায় যে, তা বরকতময়ও বটে। কারণ বাকি বিক্রয়ের ফলে যার হাতে বর্তমানে নগদ অর্থ নেই সেও পণ্য কিনে তার সমস্যার সমাধান করতে পারে। বাকিতে ক্রয় করার মাধ্যমে ক্রেতা তার অভাব পূরণ করতে পারেন। আবার বিক্রয়কারীও তার পণ্য বিক্রি করে মুনাফা (Profit) অর্জন করতে পারেন। এভাবে মানুষের সমস্যার সমাধান হয় বলে আল্লাহ্ তায়ালা বাকি বিক্রেতার সম্পদে বরকত দেন।

 

‘হেদায়া’ এবং ‘মুজাল্লাতুল আহকাম আল আদালিয়াহ’ গ্রন্থদ্বয়ে বলা হয়েছে, ‘বাকিতে পণ্য বিক্রি বৈধ, তবে শর্ত হলো মূল্য পরিশোধের তারিখ সুনির্ধারিত হতে হবে। কারণ মূল্য পরিশোধের তারিখের অজ্ঞতার জন্য ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি দ্বারা যে মূল্য পরিশোধ ওয়াজিব হয়; তা আদায়ে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বিক্রেতা চায় মূল্য দ্রুত আদায় করে নিতে, আর ক্রেতা চায় দেরিতে পরিশোধ করতে’। (ফলে তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়)।

 

এ প্রসঙ্গে মুফতি মুহাম্মদ তাকী উছমানী বলেন, “বায়’ মু’আজ্জাল বৈধ, তবে শর্ত হলো মূল্য পরিশোধের তারিখ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে নিতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “মূল্য পরিশোধের সময় নির্দিষ্ট তারিখের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যেতে পারে।

যেমন : পহেলা জানুয়ারি পরিশোধ করা হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের ভিত্তিতেও হতে পারে। যেমন : তিন মাস পর পরিশোধ করা হবে; কিন্তু মূল্য পরিশোধের সময় ভবিষ্যতের এমন কোনো ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট করে নির্ধারণ করা যাবে না যার চূড়ান্ত তারিখ অনির্দিষ্ট এবং অনিশ্চিত, যদি পরিশোধের তারিখ অনির্দিষ্ট কিংবা অনিশ্চিত হয়, তাহলে বিক্রয় শুদ্ধ হবে না।

 

প্রকৃত কথা হচ্ছে বাকি ক্রয়-বিক্রয় কখনও নিষিদ্ধ ছিল না, নিষিদ্ধ নেই এবং নিষিদ্ধ হতে পারে না । বায়’ মু’আজ্জাল বৈধ হওয়ার পক্ষে কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট দলিল ছাড়াও সাধারণ যুক্তিও রয়েছে। বায়’ মু’আজ্জাল বা বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় বৈধ না হলে মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে যেত। মানুষের জীবনে এটা খুবই স্বাভাবিক যে, সবসময় তার হাতে নগদ অর্থ থাকে না। এমতাবস্থায় মানুষ বাকিতে মূল্য শর্তে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। পরিশোধের

 

বায়মুআজ্জালের প্রকারভেদ(Classification of Bai Muazzal)

 

সাধারণত তিন পদ্ধতিতে বায় মুয়াজ্জাল বা বাকিতে পণ্য বিপণন করা হতো। পদ্ধতিগুলো হলো-

 

ক. বন্ধকবিহীন বায় মুয়াজ্জাল বা বাকিতে পণ্য বিপণন,

খ. বন্ধক রেখে বায় মুয়াজ্জাল বা বাকিতে পণ্য বিপণন,

 

গ. বায়না রেখে বায় মুয়াজ্জাল বা বাকিতে পণ্য বিপণন,

 

নিচে এ তিন পদ্ধতির বেচাকেনা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। ক. বন্ধকবিহীন বায় মুয়াজ্জাল বা বাকিতে পণ্য বিপণন

 

রাসূল (সা.)-এর যুগে সাহাবাগণ একে অপরের কাছে বন্ধক ব্যতিরেকে বাকিতে পণ্য বিক্রয় করত। কারণ :

 

১. এ জাতীয় ক্রয়বিক্রয়ও Gli, “আল্লাহ তায়ালা বেচাকেনা বৈধ করেছেন, আর সুদ হারাম করেছেন। এর অন্তর্ভুক্ত।

 

২. বন্ধকবিহীন বাকিতে পণ্য বিপণন বৈধ প্রমাণ করার জন্যে ফকিহগণ নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারাও দলিল দিয়ে থাকেন। তাদের মতে তা মুদায়না বা বাকি লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত। যে বাকি লেনদেনের অনুমতি দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই বাণীতে বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا تَدَايَنْتُمْ بِدَيْنِ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَاكْتُبُوهُ

 

অর্থাৎ, “হে ঈমানদারগণ যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ধার-কর্জের কারবার কর তখন তা লিখে রাখো। ২৪২ এ আয়াত সব ধরনের ধার-কর্জ, এবং ঋণের লেনদেনকে তা বাকি বেচাকেনা থেকে হোক, বা কিস্তিতে বেচাকেনা থেকে হোক, বা পদ্ধতির বেচাকেনা থেকে হোক শামিল করে।

 

তাছাড়া এ জাতীয় বেচাকেনা বৈধ হওয়ার পক্ষে বেশকিছু হাদিসও পাওয়া যায়। যেমন- আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল অমুক

 

এসেছে। তার কাছে (বিক্রয়ের জন্য) সিরিয়ার কিছু কাপড় আছে। আপনি যদি তার কাছে কাউকে পাঠাতেন অতঃপর সচ্ছল হওয়ার পর আদায় করার শর্তে বাকিতে দুটি কাপড় কিনতেন (তাহলে ভালো হতো)। একথা শুনে রাসূল (সা.) এক লোককে তার কাছে পাঠালেন; কিন্তু লোকটি বাকিতে বিক্রয় করতে অস্বীকার করল

 

এ হাদীসে দেখা যায় যে, রাসূল (সা.) বাকিতে কেনার জন্য লোকটির কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু কোনো কিছু বন্ধক রাখার প্রস্তাব করেননি। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বন্ধকবিহীন বাকিতে পণ্য ক্রয়বিক্রয় করা বৈধ।

 

খ. বন্ধক রেখে বায়’ মুয়াজ্জাল বা বাকিতে পণ্য বিপণন

 

বাকিতে পণ্য বিক্রয় করার সময় পণ্য বিক্রেতা তার পণ্যের মূল্য পাওয়া গ্যারান্টি হিসেবে ক্রেতার কাছ থেকে কোনো বস্তু ইচ্ছা করলে বন্ধক রাখতে পারে। এভাবে বন্ধক রেখে পণ্য বিপণন করা ইসলামী শরিয়াহর দৃষ্টিতে বৈধ। স্বয়ং রাসূল (সা.) তার নিজের একটি বর্ম বন্ধক রেখে এক ইহুদির কাছ থেকে কিছু খাদ্য কিনেছিলেন।

 

বুখারী শরীফে আয়শা হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন,

 

اشْتَرَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ يَهُودِي طَعَامًا بِنَسِيئَةٍ

 

وَرَهَنَّهُ دِرْعَهُ

 

রাসূল (সা.) জনৈক ইহুদির কাছ থেকে কিছু খাদ্য বাকিতে কিনেছিলেন এবং তার কাছে তাঁর নিজের একটি লৌহবর্ম বন্ধক রেখে ছিলেন।

 

অপর এক হাদীস হতে জানা যায় যে, রাসুল (সা.)-এর ইন্তিকাল পর্যন্ত লৌহবর্মটি ঐ ইহুদির কাছে বন্ধক ছিল। পরে আবু বকর (রা.) তার কাছ থেকে তার পাওনা পরিশোধ করে তা ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন এবং আলী (রা.)-এর কাছে হস্তান্তর করেছিলেন ।

 

গ. বায়’ মুআজ্জালে বা বাকিতে বায়না রেখে পণ্য বিপণন

 

বাকি বেচাকেনার ক্ষেত্রে বায়না রেখে পণ্য বেচাকেনা দুইভাবে হতে পারে, যথা-

 

১. ফেরতযোগ্য বায়না : বেচাকেনার চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার সময় ক্রেতার পক্ষ হতে বিক্রেতাকে কিছু টাকা বায়নাস্বরূপ দিয়ে একথা বলা যে, পণ্যের মূল্যের বাকি টাকা পরিশোধ করে পণ্যটি নিয়ে যাব। আর বাকি টাকা পরিশোধকালে বায়নাস্বরূপ দেওয়া টাকা মূল্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ ধরনের বায়না দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে মুসলিম ফকিহদের মধ্যে কারো আপত্তি নেই।

 

২. অফেরতযোগ্য বায়না : বেচাকেনা চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার সময় ক্রেতার পক্ষ হতে বিক্রেতাকে কিছু টাকা বায়নাস্বরূপ দিয়ে একথা বলা যে, যদি বাকি টাকা পরিশোধ করে পণ্যটি নিয়ে যাই তাহলে বায়নাস্বরূপ দেওয়া টাকা মূল্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যদি পণ্য না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই তা হলে বায়নাস্বরূপ দেওয়া টাকা ফিরিয়ে দিতে হবে না। কোনো বিনিময় ছাড়াই তুমি (বিক্রেতা) তা পেয়ে যাবে। এ ধরনের বেচাকেনাকে ইসলামী ফিকাহর পরিভাষায় ‘বাইয়ূল আরবূন’ বা ‘বাইয়ূল উরবান’ বলা হয়। এ কারণেই এ ধরনের বেচাকেনার ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে মতদ্বন্দ্ব হয়েছে। কেউ কেউ এ ধরনের বেচাকেনা বৈধ, আবার কেউ কেউ অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন।

 

এ জাতীয় বেচাকেনা অবৈধ: তিন ইমাম অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফা, মালেক ও শাফেয়ী অবৈধ বলে মত প্রকাশ করেছেন। ইবনে মানযার এটা ইবনে আব্বাস ও হাসান বাসারীর অভিমত বলে দাবি করেছেন। তারা তাদের এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন তিনটি দলিলের ওপর ভিত্তি করে। দলিলগুলো হলো :

 

১. আমর ইবনে শোআইব হতে বর্ণিত। তিনি তার বাবা হতে, তার বাবা তার দাদা হতে বর্ণনা করে বলেন,

 

“রাসূল (সা.) ওরবান (অফেরতযোগ্য বায়না রেখে) পদ্ধতিতে বেচাকেনা করতে নিষেধ করেছেন।

 

এ হাদীসটি আহমদ, নাসায়ী, বাইহাকী, আবু দাউদ ও ইমাম মালেক তার মুয়াত্তা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি যতগুলো সনদে বর্ণিত হয়েছে সবগুলো সনদই দুর্বল। তবে এসব সনদের একটি অপরটিকে কিছুটা হলেও শক্তিশালী করে।

২. এ বেচাকেনা একটা বাতিল শর্ত সম্বলিত। আর তা হলো- এতে একজন অন্যজনের কিছু সম্পদ কোনো বিনিময় ছাড়া পেনো যায়।

 

৩. এতে ক্রেতা পণ্যটি না নিতে চাইলে না নেওয়ার এখতিয়ার তার থাকবে, এমন একটি শর্তও রয়েছে।

 

এ জাতীয় বেচাকেনা বৈধ : ইমাম আহমদ এ ধরনের বেচাকেনা বৈধ বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। এ অভিমত হযরত ওমর, ইবনে ওমর (রা.) ইবনে সিরীন ও সাইয়্যেদ ইবনে মুসাইয়োরেরও। তাদের হাদীস ও যুক্তিগুলো হলো-

 

১. যায়েদ ইবনে আসলাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.)-কে বেচাকেনায় ওরবান তথা অফেরতযোগ্য বায়না গ্রহণ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি তা হালাল বলে মন্তব্য করেন । ”

 

২. মুহাম্মদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত। কাউয়া وسلم ان النبي صلى ا নানা রাসূল (সা.) বেচাকেনায় গুরবান (অফেরতযোগ্য বায়না) গ্রহণ হালাল ঘোষণা করেছেন।

 

এ হাদীস দুটি ইবন আবু শাইবা তার মুছান্নাফ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এ

 

দু’টি হাদীসের সনদও মুরসাল বা দুর্বল। এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে একজন বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য নয়।

 

৩. ওমর (রা.) কর্তৃক নিয়োগকৃত মক্কার গভর্নর-

 

أَنَّ نَافِعَ بِنْ عَبْدُ الْحَارِثُ اشْتَرَى دَارُ السِّجْنُ مِنْ صَفْوَانُ بِن أُمَيَّةَ بِأَرْبَعَةِ الآن دِرْهُمْ ، فَإِن رَضِيَ عَمَرُ فَالْبَيْعَ لَهُ، وَإِنْ عَمَرُ لَمْ يُرْضَ فَارْبَعَةَ لِصَفْوَانَ

 

নাফি ইবনে আব্দুল হারেছ থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি মক্কার সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা হতে চার হাজার দিরহামের বিনিময়ে আসসিজিন নামক বাড়িটি এ শর্তে ক্রয় করেছিলেন যে, খলীফা ওমর রাজি হলে বেচাকেনাটি চূড়ান্ত হবে। আর তিনি রাজি না হলে সাফওয়ান (বায়নাস্বরূপ দেওয়া) চার শত দিরহাম পাবেন।

 

এ প্রসঙ্গে ড. ইউসুফ আল কারযাভী বলেন, আমরা লক্ষ করেছি যে, ইমাম আহমদ হযরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছারের ওপর নির্ভর করেছেন। তিনি বেচাকেনা চূড়ান্ত না হওয়া অবস্থায় এরবান বা অফেরতযোগ্য বায়নার টাকা গ্রহণকে অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ আত্মসাৎ বলে মনে করেননি। এ যুগের জন্য ইমাম আহমদের এ অভিমতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। কারণ এ অভিমতটি ইসলামী শরিয়াহ- যা কি-না মানুষের কষ্ট লাঘব ও দূরীভূত করার নিমিত্তে সহজ বিধান হিসেবে এসেছে- এর উদ্দেশ্যের সাথে অধিক সামঞ্জস্যশীল।

 

প্রফেসর খলীল মুস্তাফা আযযারকা’র মতে এ কথা সর্বজ্ঞাত যে, ওরবান পদ্ধতিটি আধুনিক কালের ব্যবসায় সংক্রান্ত আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতির ওপর নির্ভরশীল। এটাই ব্যবসায়ী চুক্তির ভিত্তি। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর বেচাকেনা চুক্তি বাতিল করার কারণে এক পক্ষের যে ক্ষতি অবধারিত তা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে (লক্ষ করা গেছে যে, অপেক্ষমাণ কালে উপযুক্ত মূল্যে পণ্যটি বিক্রয় করার একাধিক সুযোগ চলে যায়)।

 

বায়’ মুআজ্জালে পণ্যের দাম বাজারদরের চেয়ে বেশি ধার্যকরণ বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় অনুসৃত বায় মুআজ্জালে মূল্য পরিশোধের জন্য ক্রেতাকে দীর্ঘ সময় দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ক্রেতার কাছ থেকে বাজারদরের চেয়ে বেশি মূল্য নেওয়া হয়। সময়ের বিপরীতে কোনো পণ্যের বাজারদরের চেয়ে বেশি মূল্য ধার্য করা বৈধ কিনা? এ বিষয়টি জানার জন্যে আমরা মহানবী ও সাহাবাদের যুগে বাকি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কিভাবে মূল্য ধার্য করা হতো, তা দেখার চেষ্টা করেছি। আমরা দেখতে পেয়েছি যে, সে যুগেও বাকি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাজারদরের চেয়ে পণ্যের মূল্য বেশি ধার্য। করা হতো। এখানে পাঠকদের সামনে প্রমাণগুলো পেশ করা হলো :

 

ক. আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে মক্কার কাফিরদের উক্তি নকল করে বলেন, না । তারা বলে ক্রয়বিক্রয় তো রিবার মতোই  প্রখ্যাত মুফাসসির ইবনে আবি হাতিম সাঈদ ইবনে যুবায়েরের সূত্রে মক্কার কাফেরদের এ উক্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা বিক্রয়কালে বেশিদাম ধার্য করি বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে পাওনার পরিমাণ বাড়াই, কথা একই। উভয়ই সমান। কুরআন মজিদে উল্লিখিত আয়াতে কাফেরদের এই আপত্তির কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা বলে ক্রয়বিক্রয় তো রিবার মতোই।

 

অর্থাৎ কাফেরদের আপত্তি হলো এখানে যে, যখন আমরা পণ্য বাকিতে বিক্রয় করি তখন দাম পরে পাওয়া যাবে এবং এ কারণে বিক্রয়মূল্য বাড়িয়ে ধার্য করি, আর তা বৈধ বিক্রয় বলে গণ্য হয়; কিন্তু বাকিতে বিক্রয় করার পর দেনাদার যদি নির্ধারিত সময়ে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন পাওনার পরিমাণ বৃদ্ধি করলে তাকে বলা হয় রিবা। অথচ উভয় ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির ধরন একই রকম।

উপর্যুক্ত বর্ণনা হতে বোঝা যায় যে, সেকালে বাকি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাজারদরের চেয়ে বেশি মূল্য ধার্যকরণ একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনেরও কোনো আপত্তি ছিল না। পবিত্র কুরআনের আপত্তি হলো, সময় বৃদ্ধি করে দিয়ে মূল্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেওয়াকে সুদ না বলে বাকি বিক্রিতে বেশি মূল্য ধার্যকরণের সাথে তুলনা ও একাকার করার ব্যাপারে।

 

খ. আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةٌ

 

عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ

 

অর্থাৎ, “হে ঈমানদারগণ তোমরা তোমাদের পরস্পরের সম্পদ বাতিলভাবে খাবে না, তবে তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে ব্যবসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে খেতে পারো।’ এ আয়াতে একজনের সম্পদ আরেকজনকে বাতিলভাবে তার  অনুমতিবিহীন খেতে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থায় অনুসৃত বায় মুয়াজ্জল-এ কারো সম্পদ কেউ বাতিলভাবে খায় না। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিক্রমেই ক্রয়মূল্যের উপর অতিরিক্ত মূল্য ধার্য করে বিক্রয় চুক্তি সম্পাদিত হয়। কাজেই এই অতিরিক্ত ধার্যকরণ কিছুতেই বাতিল ও নিষিদ্ধ হতে পারে না। কারণ তা উভয়ের সম্মতিক্রমেই হয়ে থাকে।

 

বায়মুআজ্জালের শর্তাবলি(Terms of Bai-Muazzal)

 

১. গ্রাহকের কাছে বিক্রির আগে সংশ্লিষ্ট মাল ব্যাংকের মালিকানায় ও দখলে থাকতে হবে। শরী’আহর বিধান অনুসারে যা নিজের মালিকানায় নেই, তা বিক্রি করা যায় না।

 

২. মাল ক্রয়ের পর থেকে ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করার আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মালের হারিয়ে যাওয়া, চুরি হওয়া, নষ্ট হওয়া ইত্যাদি যেকোনো ক্ষয়-ক্ষতির দায়- দায়িত্ব ব্যাংক (বিক্রেতা) বহন করবে। শরী’আহর দৃষ্টিতে ঝুঁকি বহন না করে মুনাফা করা বৈধ নয়।

 

৩. গ্রাহকের ফরমায়েশ অনুযায়ী মাল ক্রয়ের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের দায়িত্ব ব্যাংক বা তার প্রতিনিধির। সে প্রতিনিধি কোনক্রমেই ফরমায়েশ দানকারী ক্রেতা হবে না। মালের পরিবহন ও বিক্রির আগ পর্যন্ত সংরক্ষণের দায়িত্ব ব্যাংকের।

 

৪. বায়’ মু’আজ্জাল পদ্ধতিতে একবার পণ্যের দাম ঠিক হলে তা আর পরিবর্তন করা যায় না। ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে ক্রেতা দেরি করলে অতিরিক্ত সময়ের লাভের হার বা দাম বাড়ানো যাবে না।

 

৫. মালের বিক্রয়মূল্য নির্দিষ্ট হতে হবে এবং তা চুক্তিপত্রে স্পষ্ট থাকতে হবে।

 

৬. ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কিত ইজাব ও কবুল-এর সময়ই মালের বিক্রয়মূল্য পরিশোধের সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে, যেন পরবর্তীতে কোনো ফেতনার সৃষ্টি না হয়।

 

৭. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্রাহক পাওনা টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।

 

৮. এ পদ্ধতিতে পণ্যের ক্রয়মূল্য, লাভের পরিমাণ এবং আনুষঙ্গিক খরচ ক্রেতাকে বলতে বা চুক্তিতে উল্লেখ করতে বিক্রেতা বাধ্য নয়। পণ্যের বিক্রয়মূল্য উল্লেখ থাকলেই চলবে।

 

৯. ক্রয়-বিক্রয়ে এরূপ বলা যাবে না- যেমন, নগদ হলে ২ লাখ টাকা আর বাকি হলে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা; এরূপ বলা হলে অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা ইসলামী শরী’আতে সুদ হিসেবে পরিগণিত হবে।

 

বায়মুআজ্জালের বৈশিষ্ট্য(Characteristics of Bai-Muazzal)

 

. তিনটি পক্ষ : বায়’ মু’আজ্জালে ব্যাংকের ক্ষেত্রে তিনটি পক্ষ থাকতে হবে। যথা : (ক) প্রথম বিক্রেতা (পণ্য বিক্রেতা/ মালের/পণ্যের মূল্য সরবরাহকারী। (খ) প্রথম ক্রেতা (ব্যাংক) যিনি পরে আবার বিক্রেতা- অর্থায়নকারী। (গ) দ্বিতীয় ক্রেতা (বিনিয়োগ গ্রাহক) যিনি প্রথম ক্রেতার নিকট থেকে ক্রয় করেন।

 

এ পদ্ধতিতে ব্যাংক হচ্ছে ক্রেতা এবং গ্রাহক হচ্ছে বিক্রেতা। এ পদ্ধতিতে ব্যাংক সাধারণত কৃষি ও শিল্পপণ্য অগ্রিম ক্রয় করে থাকে। অন্যকথায় ব্যাংক গ্রাহকের অনুরোধে কৃষি ও শিল্পসহ বিভিন্ন খাতের উপকরণ ও মালামাল ক্রয় করে গ্রাহকের নিকট তা বাকিতে বিক্রয় করে।

 

. মূল্য পরিশোধ : ব্যাংক বাজারে পণ্য বিক্রেতাকে/সরবরাহকারীকে মূল্য পরিশোধ করবে।

 

. বিনিয়োগ গ্রাহকের মূল্য নির্ধারণ : বায়’ মু’আজ্জাল চুক্তি করার সময় পণ্যমূল্য নির্ধারিত হয় এবং মূল্য পরিশোধের নিয়ম ও কিস্তি নির্ধারণের ফলে ঠিক হয়ে যায়। ফলে চুক্তির পক্ষদ্বয়ের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত কোনো ‘ঘারার’ বা অনিশ্চয়তা থাকে না যা ভবিষ্যতে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে।

 

. ক্রয়মূল্য লাভের পরিমাণ গ্রাহককে জানানো : বায়’ মু’আজ্জাল ক্রয়মূল্যের সাথে মুনাফা যোগ করে দাম নির্ধারণ করা হয়; যাতে ক্রয়মূল্য ও মুনাফা আলাদাভাবে গ্রাহককে জানাতে বাধ্য নয়। গ্রাহক ব্যাংক থেকে যে দামে ক্রয় করবে শুধু সে দামই চুক্তিপত্রে উল্লেখ থাকবে। তবে মূল্য নির্ধারণ ইনসাফভিত্তিক হতে হবে।

 

. মালিকানা : ব্যাংককে পণ্যের মালিক হতে হয়। পণ্য ক্রয় করে মালিকানা লাভ করার পর বিক্রয় হচ্ছে শর্ত। এ পদ্ধতিতে আয় হালাল করতে হলে প্রথমে ব্যাংককে গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে তার উপর ব্যাংকের মালিকানা ও দখল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অতঃপর গ্রাহকের কাছে নির্ধারিত দামে এবং নির্দিষ্ট সময়ে দাম পরিশোধ করার শর্তে বিক্রয় করতে হবে।

 

. ঝুঁকি বহন : মালামাল ক্রয়ের পর ক্রেতার/গ্রাহকের কাছে বিক্রয় ও হস্তান্তর করার পূর্ব পর্যন্ত মালের ঝুঁকি বহন করতে হয়। ব্যাংক যখনই মাল ক্রয় করবে এবং মালের উপর যখনই ব্যাংকের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন থেকে গ্রাহকের কাছে হস্তান্তর করার পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মালের ক্ষয়ক্ষতি, হারিয়ে যাওয়া, চুরি যাওয়া, নষ্ট হওয়া ইত্যাদি যে কোনো ক্ষয়-ক্ষতির দায়িত্ব ও ঝুঁকি ব্যাংককে বহন করতে হবে।

 

. রূপান্তর : মালামাল ক্রয় করে অর্থকে মালে রূপান্তর এবং মাল বিক্রি করে মালকে অর্থে রূপান্তর করা হয় রূপান্তরের সুযোগ ও ঝুঁকি থাকার কারণেই এ পদ্ধতি বৈধ ।

 

. পণ্য নিয়ন্ত্রণ : পণ্যের উপর ক্রেতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। অন্যকথায় পণ্যসামগ্রী ক্রেতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া হয়। পণ্য ও তার মালিকানা একই সময়ে হস্তান্তরিত হয়ে যায় ।

 

. সহায়ক জামানত সহায়ক জামানত অবশ্যই গ্রহণ করা হয়: ব্যাংক পণ্য সরবরাহের সময় গ্রাহকের নিকট থেকে সহায়ক জামানত গ্রহণ করে। এ জামানতের মূল্য কোনক্রমেই সরবরাহকৃত পণ্যের মূল্যের চাইতে কম হবে না।

 

১০. বিক্রয় মূল্য পরিবর্তন করা যায় না : বায়’ মু’আজ্জাল পদ্ধতিতে একবার পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয়ে গেলে তা আর পরিবর্তন করা যায় না। গ্রাহক নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রয়মূল্য পরিশোধ করতে না পারলে তার পরিমাণ আর বাড়ানো যায় না। অন্যকথায় পণ্যের মূল্য একবার নির্ধারণ করার পর সময়ের কারণে তা পুনঃনির্ধারণের সুযোগ নেই।

 

১১. ক্ষতিপূরণ আদায় : পূর্বেই বলা হয়েছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্রাহক পণ্যের মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হলে ব্যাংক বিক্রয় মূল্যের অতিরিক্ত কোনো অর্থ আদায় করতে পারে না। তবে গ্রাহকের নিকট থেকে শর্তানুযায়ী ক্ষতিপূরণ (Compensation) আদায় করতে পারে। অবশ্য ক্ষতিপূরণ বাবদ আদায়কৃত অর্থ ব্যাংকের আয় হিসেবে গণ্য হয় না। জনহিতকর কাজে তা ব্যবহার করা হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *