ধর্ম : ধর্ম এর বৈশিষ্ট্য ও ধর্ম এর প্রয়োজনীয়তা

ধর্ম কী? ধর্ম এর বৈশিষ্ট্য ও ধর্ম এর প্রয়োজনীয়তা

ধর্ম অর্থ কী? ধর্মের বৈশিষ্ট্য ও ধর্মের প্রয়োজনীয়তা

ঈশ্বরোপাসনা পদ্ধতি, আচার-আচরণ, পূণ্যকর্ম, কর্তব্যকর্ম, স্বভাব, গুণ, নৈতিক সততা, পরকাল বিষয়ক নির্দেশ, উচিৎ কর্ম, উপাসনা প্রণালী, বিশেষ পুণ্যকর কাজ প্রভৃতি ধর্ম। শব্দের অন্তর্ভুক্ত।

 

অভিধান মতে-সৎসঙ্গ; দীপিকা মতে পুরুষের বিহিতক্রিয়াসাধ্য গুণ; মহাভারত মতে অহিংসা; পুরাণ মতে- যা দ্বারা লোক স্থিতি বিহিত হয়; যুক্তিবাদী মতে- মানুষের যা কর্তব্য তা সম্পাদন; জ্ঞানবাদ মতে- মনের যে প্রবৃত্তি দ্বারা বিশ্ববিধাতা পরমাত্মার প্রতি ভক্তি জন্মে তাই ধর্ম। ধর্ম শব্দের ধাতুগত অর্থ হল- ‘ধৃ’ ধাতুর সঙ্গে ‘মন’ প্রত্যয় যোগে সংস্কৃত ভাষায় শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ ‘মনকে যা ধারণ করে’। ‘“অন্তর এবং বাহির মিলে মানুষের জীবনের যে পূর্ণ সামঞ্জস্য তার মধ্যে যা মানুষের জীবনকে ধরে রাখে, সামাজিক জীবনের বৃহত্তর ঐক্যের মধ্যে যা মানুষের জীবনকে ধরে রাখে তাকেই ধর্ম বলা যেতে পারে।”

 

Religion শব্দের অর্থ

ইংরাজী Religion শব্দটি ‘Religare’ শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এর অর্থ বন্ধন (bond) বা যা দৃঢ়ভাবে বেঁধে রাখে। শব্দটির অন্তনির্হিত তাৎপর্য হল নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ (taboo বা restrain)। Lactantius মনে করেন এর অর্থ নিয়ন্ত্রণ নয় বরং ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধন বা ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণ (bond বা attraction to God) Cicero মনে করেন এর অর্থ পুন:রায় পাঠ করা বা পুনরাবৃত্তি করা (to read over again, rehearse)। Rhys Davids মনে করেন এর অর্থ একটি নিয়মনিষ্ঠ, দ্বিধাগ্রস্ত, বিবেকী মনের গঠন (a law abiding scrupulously, conscientious frame of mind)

 

Religion শব্দটি ল্যাটিন re + ligare থেকে যা পুন: একত্রিকরণ বা বাঁধা অর্থ প্রকাশ করে। তাই কারো কারো মতে Re অর্থ পশ্চাত এবং ligare অর্থ নিয়ে যাওয়া পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরালে যা নিয়ে যায় অর্থাৎ ঈশ্বরের অভিমুখে যা জীবকে নিয়ে যায় তাই হল religion ইংরাজীতে ‘Religion’ শব্দের সংজ্ঞায় বলা হয় “Belief in a higher unseen controlling power especially in a personal God.” (অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক শক্তির বিশেষত: ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস )। Any system of faith and worship, rites or worship, devoted fidelity. (ভক্তিপূর্ণ বা নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্য )। An action that one is bound to do (এমন কর্ম যা কেউ করতে বাধ্য বা ধর্মাচারণের মত অবশ্য করণীয় কর্ম।)

 

 

ধর্ম এর সংজ্ঞা

ধর্ম মানুষের জন্য একটি শাশ্বত বিধান। মানুষের স্বভাবের মধ্যে ধর্মের বীজ নিহিত। আছে। ইন্দ্ৰিয়লব্ধ জ্ঞান দিয়ে ধর্মের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যায় মাত্র, কিন্তু তা প্রকৃত সত্যে পৌঁছায়না। ফলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে তাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। বস্তুবাদী, সমাজতত্ত্ববিদ অথবা দার্শনিক ধর্ম সম্পর্কে যে সব তত্ত্বের অবতারণা করেন তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয় এবং তাদের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয় আছে। ওহী বা প্রত্যাদেশ যে বিধান মানব জাতির জন্য স্থির করে দেয় তা অভ্রান্ত ও কল্যাণকর।

ধর্ম মানুষের জন্য প্রত্যাদেশিত প্রাচীন বিধান। ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো অপরিবর্তনীয়, কিন্তু বিভিন্ন যুগে নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে প্রত্যাদেশের ভিত্তিতে কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে ধর্মের রূপ ও প্রকৃতিতেও বিবর্তন সাধিত হয়েছে।

 

ধর্ম পরিচিতি

অন্যদিকে মানুষ ইন্দ্ৰিয়লব্ধ জ্ঞান দ্বারা বিভিন্ন সমাজের আচার পদ্ধতি ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করে ধর্মের প্রকৃতি ও স্বরূপ আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছে। ফলে কোন ধর্মে একেশ্বরবাদ অক্ষুণ্ণ রয়েছে, আবার কোন ধর্মে পৌত্তলিকতার প্রভাবে বহু ঈশ্বরবাদ জন্ম নিয়েছে, আবার কোন কোন ধর্মে ঈশ্বরতত্ত্ব গৌণ বিবেচিত হয়েছে। ধর্ম অতি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন সমাজে ধর্ম এক নয়। কোন ধর্মে একেশ্বরবাদ, কোন ধর্মে দ্বৈতবাদ, কোন ধর্মে ত্রিত্ববাদ, কোন ধর্মে বহু ঈশ্বরবাদ, আবার কোন ধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্বই নেই, কাজেই ধর্ম যেমন প্রাচীন এর সংজ্ঞা দেওয়াও তেমন কঠিন। দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীরা ধর্মকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন তা পর্যালোচনা করলে তিন শ্রেণীর” সংজ্ঞা লক্ষ্য করা যায়।

ক. মূল্যবোধভিত্তিক সংজ্ঞা: এই সংজ্ঞায় ধর্ম কি হওয়া উচিৎ তা আলোচনা করে একটি নির্দিষ্ট মূল্যবোধের ভিত্তিতে ধর্মকে যাচাই করা হয়।

খ. বর্ণনামূলক সংজ্ঞা: এই সংজ্ঞায় কতিপয় বিশ্বাস ও আচারের বর্ণনা দেয়া হয় যেগুলো ধর্ম বিশ্বাসের অঙ্গ বলে মনে করা হয়।

গ. কার্মিক বা ক্রিয়াবাদী সংজ্ঞা: এই সংজ্ঞায় ধর্মের করণীয় কাজগুলো আলোচনা করা হয়।

ঘ. অমুসলিমদের দৃষ্টিকোন থেকে ধর্মের সংজ্ঞা

 

মূল্যবোধভিত্তিক সংজ্ঞার উপমা হিসেবে বলা যায়, Harold Hoffding বলেছেন, “ধর্ম হল মূল্যের নিত্যতায় বিশ্বাস (faith in the conservation of values)। মূল্যের অবিনশ্বরতা ধর্মের স্বতঃসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য।” এই সংজ্ঞায় এমন এক পরম মূল্যে বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে যিনি চিরন্তনী সত্তা। এই সত্তাই হল ঐশ্বরিক আত্মা। Hegel এর মতে “ধর্ম হল সসীম আত্মার তপস্যার মাধ্যমে ঐশ্বরিক আত্মার জ্ঞান।

মায়েল এডওয়ার্ডস্ (Miall Edwards) বলেন, “ধর্ম-সম্পৰ্কীয় জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির সত্যতার প্রশ্ন প্রধানত: আমাদের পরম মূল্যের বাস্তবতার প্রশ্ন। “১ তিনি ধর্ম বলতে আমাদের পরম মূল্যের বাস্তবতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যার প্রতি পরম মূল্য আরোপ করা হয় তিনি অসীম। ম্যাক্সমূলারের (Max Muller) মতে (A perception orapprehension of the infinite) “ধর্ম হল অসীমের প্রত্যক্ষণ বা উপলব্ধি ৩২ নিজেকে উৎসর্গ করতে পারলে অসীমের নৈকট্য লাভ সম্ভব হয়। তাই ম্যাকেঞ্জী (Mackenzie) “মানব জীবনকে পূর্ণ করে তোলার জন্য ধর্মকে উৎসর্গমূলক মনোভাব বলে গণ্য করেছেন।

মহর্ষি পতঞ্জলী যোগদর্শনে ধর্মের সংজ্ঞায় বলেন, ‘যোগ্যতাবচ্ছিন্না ধর্মিন: শক্তিরের ধর্ম। যোগ্যতাবিশিষ্ট ধর্মীর বা পদার্থের কার্যসাধিকা শক্তিই ধর্ম। বিশ্বজগতে প্রত্যেক পদার্থের অস্তিত্ব রক্ষা করে তার অন্তর্নিহিত শক্তি। এই শক্তি কোন মানবিক নয়। এই শক্তি অতিমানবিক-অতিপ্রাকৃত ।

বর্ণনামূলক সংজ্ঞায় উল্লেখ্য যে, Prof. A. Bharati মনে করেন, “অতিমানবিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার যে কলা-কৌশল তাই ধর্ম। ৩৫ অতিমানবিক শক্তিকে মানবিক শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়না। বরং তাকে তুষ্ট করা যায়। তুষ্ট করার প্রয়াসকে ধর্ম বলা যায়। তাই Jems Freazer বলেন, “ধর্ম হচ্ছে মানুষের চেয়ে উচ্চতর এমন শক্তির সন্তুষ্টি বিধানের প্রচেষ্টা যা ও প্রকৃতির ধারাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে।” তাঁর মতে ধর্মের উপাদান দু’টি একটি মানুষের চেয়ে উচ্চতর শক্তিতে বিশ্বাস; আর অপরটি সেই অতিমানবিক শক্তির আরাধনা। ফরাসী সমাজ বিজ্ঞানী এমিল দুরখাইমের মতে ধর্মের উপাদান দু’টি। বিশ্বাস এবং আচার। তিনি জগৎসংসারে পরস্পর বিরোধী দু’টি বিষয় লক্ষ্য করেছেন, পবিত্র ও অপবিত্র।” দেব, দেবী, ঈশ্বর, ভূত, প্রেত, প্রেতাত্মা, সবই পবিত্র জগতের অঙ্গ। তাই অপবিত্র জগৎ হচ্ছে, জীবিকার সন্ধানে পরিশ্রমী মানুষের দৈনন্দিন জীবন। ধর্ম বিশ্বাসের বর্ণনা প্রসঙ্গে নৃবিজ্ঞানী টেইলার (E.B. Tylor) বলেন, “ধর্ম হল, আত্মায় বিশ্বাস”। ৩৮ এখানে শুধু আত্মা বা প্রেতাত্মায় বিশ্বাসকে ধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ধর্মের বিশদ বর্ণনা উপস্থাপিত হয়নি।

নৃবিজ্ঞানী C.R. Ember বলেন, “ধর্ম হল এমন কিছু আচরণ, বিশ্বাস বা চর্চা যা কোন অতিপ্রাকৃত শক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে বিশ্বাস ও আচারের সমষ্টিকে ধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই আচারগুলো বর্ণনা করা হয়নি।

সামনে উপস্থিত থেকে মানুষের মনে যে ভীতি ও আত্মঅবমাননার ভাব জাগ্রত হয়েছে তা অবশ্যই ধর্মীয় অনুভূতি যা উপাসনা ও প্রার্থনার মূলে বর্তমান।

ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন মণীষী যে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তা কোন না কোন দিক থেকে সমালোচিত। ধর্ম বিভিন্ন, কাজেই সংজ্ঞাও বিভিন্ন। যে ধর্মমত যত পূর্ণাঙ্গ তার সংজ্ঞাও তত গ্রহণযোগ্য। যেহেতু ইসলাম ধর্মসমূহের বিবর্তনের শেষ স্তর এবং পরিপূর্ণ ধর্ম সেহেতু তার আলোকে একটি বাস্তব ভিত্তিক সংজ্ঞা হওয়াই বাঞ্ছনীয় ।

 

ধর্মের বৈশিষ্ট্য

১. ঈশ্বরের অস্তিত্ব: পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস। এইসব ধর্মে স্বীকার করা হয়েছে যে মহাবিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। ইসলাম, ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মে এক আল্লাহর কথা বলা হয়েছে। তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এতদসত্ত্বেও ইয়াহুদী ও খ্রীস্টান ধর্মে ঈশ্বরতত্ত্বে কিছুটা সংযোজন করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে বহু ঈশ্বরের কথা আছে। বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বর সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলেও বৌদ্ধ স্বয়ং ভগবান রূপে পূজিত।

২. ঐশী গ্রন্থঃ প্রধান প্রধান ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ঐশীগ্রন্থে বিশ্বাস। ইসলামে আল-কুরআন, ইয়াহুদী ধর্মে তৌরাহ, তালমুদ, খ্রীষ্টান ধর্মে ইঞ্জিল, বৌদ্ধ ধর্মে ত্রিপিটক, যরথুষ্ট ধর্মে যিন্দাবেস্তা, হিন্দু ধর্মে বেদ, পুরাণ প্রভৃতি ঐশী ধর্মগ্রন্থ।

৩. প্রেরিতত্ব বা ধর্মাবতার: আল্লাহ তা’আলা ইসলামে অসংখ্য নবী-রসূল প্রেরণ করেছিলেন, ইয়াহুদীদের মতে মূসা (আ.) এবং ইসরাঈল বংশীয় নবীগণ ও হারূন (আ.), খ্রীষ্টানদের মতে ঈসা (আ.) তাদের নবী। হিন্দু ধর্মে ঋষীগণ প্রেরিত মহাপুরুষ, আর বৌদ্ধ ধর্মে বৌদ্ধ স্বয়ং প্রেরিত মহাপুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হলেও ভক্তদের কাছে তিনি ভগবান।

৪. উপাসনা: উল্লেখযোগ্য ধর্মসমূহে উপাসনার জন্য উপাসনালয় আছে। যেমন

  • ইসলামে মসজিদ,
  • খ্রীষ্টান ধর্মে গীর্জা,
  • ইয়াহুদী ধর্মে সিনেগগ,
  • হিন্দু ধর্মে মন্দির এবং
  • বৌদ্ধধর্মে মঠ-প্যাগোডা।

৫. আত্মার অমরতা: ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মা আসে মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং আবার তাঁর কাছেই ফিরে যায়।” আত্মা অমর। এমত ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদেরও। তাঁরা মৃত্যু পরবর্তী জীবন পরকালে বিশ্বাস করে। কিন্তু হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে আত্মাকে অমর বললেও তারা পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে ।

 ৬. মানবকল্যাণ: ধর্ম মানবকল্যাণ নির্দেশ করে এবং সৌহদ, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, শৃঙ্খলা,পরোপকার প্রভৃতি সমাজকল্যাণ ও মানবকল্যাণ নির্দেশ করে।

৭. নৈতিকতা: ধর্ম সর্বদা মানুষের জবাবদিহিতা মূলক নৈতিকতায় উজ্জীবিত করে।

 

ধর্মের প্রয়োজনীয়তা

মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে দীন বিজড়িত। মানুষের সৃষ্টিলগ্ন থেকে আদেশ ও নিষেধ এবং গ্রহণ ও বর্জন যা দীনের প্রতিপালনীয় বিষয় দ্বারা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ বা সুরক্ষা দান করা হয়েছে। মানুষের কুপ্রবৃত্তি দমন ও সুকুমার বৃত্তির প্রতিপালনের জন্য দীন সূচিত হয়েছে। সভ্যতা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখে দীনও পরিমার্জিত হয়েছে। পার্থিব জীবনে দীনের (ধর্মের) প্রয়োজনীয়তা

১. সহজাত প্রবৃত্তি বা প্রবৃত্তির চাহিদা: ধর্মপ্রবণতা মানুষের সহজাত স্বভাব । জন্মগতভাবে নিরপেক্ষ ও বিশুদ্ধ স্বভাব নিয়ে জন্মায়।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, فأقيم وجهك للدين حنيفا فطرة الله التي قطر الناس عليها لا تبديل لخلق الله ذلك الدين القيم ولكن أكثر الناس لا يعلمون )

‘অতএব তুমি একনিষ্ঠ হয়ে দীনের জন্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর প্রকৃতি, যে প্রকৃতির ওপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’

হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা:) বলেছেন প্রতিটি শিশুই প্রকৃতির ওপর জন্মগ্রহণ করে, অতপর তার বাবা-মা তাকে ইয়াহুদী, খ্রীষ্টান ও অগ্নিপূজকে পরিণত করে।’সুপ্রবৃত্তি দ্বারা বিশুদ্ধ জীবন যাপনের জন্য দীনের প্রয়োজনীয়তা আছে।

 

২. সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি: মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে কী উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন তা দীনের মাধ্যমে জানা যায়। আল্লাহ তা’আলা অনর্থক কোন কিছু সৃষ্টি করেননি। তাই তিনি বলেন, ”  ‘তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে কেবল অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে না? ‘অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে।

”আর জ্বীন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদত করবে।’

৩. বিধি-বিধান অবহিত করণ: দীন মানুষকে সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য ঐশ্বরিক বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়। যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল বিধি-নিষেধ শিক্ষা দিয়েছেন এবং বিধি-নিষেধ কার্যকর করার জন্য যুগে যুগে প্রতিনিধিগণ তৎপর রয়েছেন।”

‘তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে।”

৪. আত্মার পবিত্রতা: মানুষের মনে সন্দেহ ও সংশয় বিদ্যমান। দীনের বাণী অন্তর থেকে সংশয়ের পঙ্কিলতা দূর করে আত্মিক পবিত্রতা দান করে। তাছাড়া মানুষ কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে দীনের প্রকৃত বিধান থেকে বিচ্যুত হয়। প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ দীন প্রচার করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,و هو الذي بعث في الأميين رسولا منهم يتلو عليهم آياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة وإن كانوا من قبل لفي ضلال مبين )

তিনিই নিরক্ষরদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে; তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত; ইতঃপূর্বে তো এরা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।’

 

৫. সামাজিক পরিবর্তন: মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। সমাজ গঠন ও পরিচালনার সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য দীনের প্রয়োজন। সমাজ সংস্কারের জন্য এবং সমাজের প্রচলিত খারাপ রীতি-নীতি, আচার-আচরণ পরিবর্তনের জন্য একটি নমুনা থাকা প্রয়োজন। দীন সেই অনুস্মরণীয় নমুনা হিসেবে কাজ করে। আল্লাহ বলেন,

“তিনি সেই মহান সত্তা যিনি সৎপথ ও সত্যদীনসহ তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি অন্যসব ধর্মের উপর ইসলাম ধর্মকে বিজয়ী করেছেন।’

 

৬. স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সুসম্পর্ক স্থাপন: সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে যে সম্পর্ক তা আনুগত্যের সম্পর্কে হে বিশ্বাসীগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যেমন করে ভয় করা উচিৎ। আর মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না।’ আর এই আল্লাহ এক না হয়ে একাধিক হত তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত।৮১ এই বিশৃঙ্খলা থেকে বাঁচার জন্য দীনের প্রয়োজন।

 

আরো জানুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *