মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি

মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি

মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি

চিকিৎসাবিজ্ঞানে ও অস্ত্রচিকিৎসায় পারদর্শিতা যে কোনো জাতির প্রতিভার লক্ষণ ও গৌরবের বিষয়। একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রাচীন জাতিসমূহের মধ্যে গ্রিকরাই সবচেয়ে উচ্চস্তরে পৌঁছেছিল। মুসলিমরা গ্রিকদের এ উত্তরাধিকারকে উজাড় করে আত্মসাৎ করে, এবং নিজেদের প্রতিভাদীপ্ত অনুশীলনে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বর্তমান যুগের উচ্চস্তরে আনয়নের পথ প্রদর্শন করে। পণ্ডিতেরা এ বিষয়ে একমত যে, মুসলিমরা চিকিৎসাবিদ্যায়, বিশেষত ভেষজ-গ্রন্থাদি রচনায় অসামান্য মৌলিকতা দেখায় ও আশ্চর্য উন্নতিসাধন করে এবং এক্ষেত্রে বর্তমান ইউরোপের উপর মুসলিমদেরই প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়।

 

কোরআন-শরীফে কোনো রোগ সম্বন্ধে সঠিক বর্ণনা দেয়া নেই সত্য, কিন্তু স্বাস্থ্যতত্ত্ব বিষয়ে প্রত্যেক মুসলমানকে অবহিত করা হয়েছে। মুসলিমরা গ্রিকদের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসাশাস্ত্রে তাদের জ্ঞানানুশীলন শুরু হয়। সিরিয়ার একটি নেস্টোরিরান পরিবার এই শাস্ত্রের চর্চায়, অধ্যাপনায় বিশেষ সাহায্য করে। পরপর সাতপুরুষ ধরে এই বিদগ্ধ পরিবারটি চিকিৎসক হিসাবে মেসোপটেমিয়ায় ও ইরানে অসামান্য খ্যাতি লাভ করে। এদেরই ঐকান্তিক চেষ্টায় গ্রিক পণ্ডিতদের চিকিৎসা ও ভেষজ গ্রন্থগুলো আরবিতে অনূদিত হয়। তাদের অনেকে বাগদাদে আব্বাসী খলিফাদের অতিপ্রিয় চিকিৎসকও ছিলেন। তাঁদেরই প্রচেষ্টায় জালিনুসের (Galon) লিখিত চিকিৎসাবিদ্যার প্রাচীন পুঁথিগুলো আরবসমাজে সুপরিচিত হয়। গোড়ার দিকে আরবদের উপর জালিনুসের প্রভাব এত বেশি ছিল যে, তাঁর শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই মুসলমানরা চিকিৎসাবিদ্যার অনুশীলন শুরু করে। হুনায়েন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৭ খ্রি.) জালিনুসের সমগ্র রচনার একখানি তর্জমা আরবিতে প্রকাশ করেন। অনুবাদকারীরা আরবিতে প্রথম থেকেই চিকিৎসা বিষয়ে বিভিন্ন সংহিতা রচনা করেছিলেন। কিন্তু পরে সংহিতার বদলে চিকিৎসাশাস্ত্রের সার সংকলনপূর্বক বিশ্বকোষের মতো বিরাট গ্রন্থ প্রণয়নের রীতি বেড়ে গেল। এ কাজে ইরানি চিন্তানায়ক ও চিকিৎসকগণই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁদের মধ্যে আল-রাজীই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।

 

মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজির জন্ম :

বর্তমান ইরানের রাজধানী তেহরানের অন্তর্গত রায়-নগরে আবুবকর মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া জন্মগ্রহণ করেন (৮৫৫ খ্রি.)। রায় এককালে মৃৎশিল্পের জন্য মশহুর ছিল এবং ১২২০ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলদের হাতে এই অতি প্রাচীন শহরটি ধ্বংস হওয়ার আগে শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে সারা মুসলিম জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। সেজন্য রাজি জন্মভূমির নামানুসারে নিজের নিসবা আল রাজী ধারণ করেছিলেন।

 

মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজির পরিবার :

আল-রাজীর পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না, তার এখান কারণ এই যে, সে আমলের আরবীরা তাদের মনীষীদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি মাথা ঘামতে না, তাঁদের সাধনালব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ ও তাদের পুঁথিপুস্তকের আলোচনাতেই মশগুল থাকত। প্রায় বিশ বছর বয়সে বিদ্যা শিক্ষার জন্য আল-রাজী বাগদাদে গমন করেন ও মশহুর চিকিৎসাবিদ ইবনে ইসহাকের নিকট চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। রসায়নশাস্ত্রেও তার অত্যন্ত দখল ছিল, এবং যৌবনে বহুদিন। তিনি আলকেমী সম্বন্ধে গভীর গবেষণা করেছিলেন। বাগদাদে অবস্থানকালে তিনি কবলমাত্র গ্রিক চিকিৎসাবিজ্ঞানই শিক্ষা করেননি, ইরানি চিকিৎসাপ্রণালি ও ভারতীয়, অনুর্বেদশাস্ত্রেও তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি পদার্থবিদ্যা প্রভৃতিতেও বিশেষ বৃৎপত্তি লাভ করেন। দর্শনশাস্ত্রেও তাঁর কম অনুরাগ ছিল না এবং গ্রিক দর্শনের তিনি একজন একনিষ্ঠ ছাত্র ছিলেন। যৌবনে মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি বীণাবাদনে ও সঙ্গীতানুশীলনে অত্যন্ত তদন্দ অনুভব করতেন, কিন্তু পরিণত বয়সে তিনি এসব চর্চা ত্যাগ করেন।

 

চিকিৎসক হিসেবে : শিক্ষা সমাপনান্তে আবুবকর কিছুদিন জুন্দেশাপুরের বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রে শিক্ষানবিশী করেন এবং আলকেমী ও ভেষজতত্ত্বে গভীর গবেষণা করেন। কিন্তু চিকিৎসক হিসাবেই তাঁর খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষে তিনি চিকিৎসা কার্যেই সারাজীবন অতিবাহিত করেন। বাগদাদ শহরে তাঁর সমকক্ষ আর দ্বিতীয় চিকিৎসক ছিল না। মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি কয়েক বছর রায়, জুন্দেশাপুর ও বাগদাদের সরকারি বিমারিস্থান’ বা হাসপাতালের অধ্যাপক পদে কাজ করেছিলেন। এই সময় পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে দলে দলে রোগীরা তাঁর কাছে নিরাময়ের আশায়। ছুটে আসত। খ্রিস্টান, ইহুদি, সিরীয়, ইরানি, প্রভৃতি জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে শিক্ষার্থীর দল তাঁর পদতলে শিক্ষালাভের আশায় ভিড় জমাত ।

 

মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজির চিকিৎসা প্রণালি ছিল যেমন আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রণালির সমধর্মী, সেই রকম তাঁর শিক্ষা প্রণালিও ছিল উন্নত ধরনের। তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিতেন, এবং বিমারিস্থানে রোগীর পাশে অবস্থান করে তাদের শুশ্রূষা করার ও তৎসঙ্গে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের উপদেশ দিতেন। ‘সার্জারী’ বা অস্ত্র চিকিৎসাতেও তাঁর হাতসাফাই ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং এ বিষয়ে তিনি গ্রিকদের চেয়েও উন্নত পন্থা অবলম্বন করতেন। রাজার হাতে চিকিৎসা লাভ করা তৎকালে রোগীরা আল্লার অপূর্ব নিয়ামত যেমন বহু পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, সেই রকম প্রচুর অর্থাগমও হয়। এভাবে প্রায় চল্লিশ মনে করত এবং সবচেয়ে নিরাপদ ভাবত। তার দরুন তাঁর খ্যাতি-সম্মান ও প্রতিপত্তি বছরেরও অধিককাল চিকিৎসাকার্যে আত্মনিয়োগ করে হাকিম আল-রাজী অসামান্য অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি কয়েক বছর নানা দেশে সফরও করেছিলেন এবং বিভিন্ন তিনি অন্ধ হয়ে পড়েন। তখন তাঁকে রক্তমোক্ষণকারী অস্ত্রচিকিৎসা (cupping) গ্রহণ শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। শেষ বয়সে তাঁর উভয় চক্ষুতেই ছানি পড়ে ও করতে বলা হলে তিনি অস্বীকার করে বলেছিলেন, “বহুদিন আমি দুনিয়ার রূপ দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি”। প্রায় আটষট্টি বছর বয়সে তিনি জান্নাতবাসী হন (৯২৫ খ্রি.)।

 

আলকেমী চর্চা : মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি আলকেমির চর্চা করতেন, আগেই বলা হয়েছে। তিনি নানা প্রকার এলকোহলিত স্পিরিটও আবিষ্কার করেন। তাছাড়া হীরাকক্ষকে শোধন করে তিনি গন্ধকদ্রাবক ভুঁতিয়া প্রস্তুত করেছিলেন, এরূপ খ্যাতিও তাঁর আছে। তিনি। কেমি বিষয়ে ‘কিতাবুল বসরার’ বা রহস্যের গ্রন্থ নামে একখানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থখানি জিরার্ড কর্তৃক লাতিন ভাষায় অনূদিত হয় (১৯৮৭ খ্রি.) এবং চতুর্দশ শতক পর্যন্ত রসায়ণশাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে এখানি সারা ইউরোপে পাঠ্যপুস্তক ছিল। আল-কেমির অনুশীলনে মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি যদিও জাবীর ইবনে হাইয়ানের মতানুসারী, তবুও তিনি পদার্থের শ্রেণি বিভাগে মৌলিকনীতি অনুসরণ করেছেন। জাবীরও অন্যান্য আরবি রসায়নবিদরা খনিজ পদার্থকে ‘জিম’ অর্থাৎ শরীর যেমন : সোনা, লোহা, রূপা ইত্যাদি), ‘নফস’ অর্থাৎ আত্মা (যেমন- গন্ধক, আর্সেনিক), ‘রূহ’ অর্থাৎ জীবনীশক্তিতে (যেমন : পারা) বিভাগ করেছিলেন। কিন্তু মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি সবরকম রাসায়নিক পদার্থকে উদ্ভিদ, প্রাণী ও খনিজ হিসাবে বিভক্ত করেছেন এবং এই শ্রেণিবিভাগ আধুনিক কালেও চলে আসছে। খনিজ পদার্থকে তিনি তরল ও নিরেট দ্রব্য, প্রস্তর, গন্ধক, সোহাগা ও লবণে বিভাগ করেছেন, এবং উদ্বায়ী ও অনুদ্বায়ী স্পিরিটে পার্থক্য দেখিয়ে শেষোক্ত পর্যায়ে তিনি গন্ধক, পারদ, আর্সেনিক ও সালএমোনিয়াককে স্থান দিয়েছেন। তিনি কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরি করার প্রণালিও উদ্ভাবন করে সবাইকে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ইউরোপে পানি থেকে কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরির প্রণালি ষোল শতক পর্যন্ত অজ্ঞাত ছিল। আল চিকিৎসা শাস্ত্রে অবদান কিন্তু মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে চিকিৎসাশাস্ত্রে। তিনি কমছে কম দশখানা কিতাব রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রেই একশোখানা। চিকিৎসার বিভিন্ন প্রণালি, রোগের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব, পাকা চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও সবরকম রোগ চিকিৎসায় অপটুতার হেতু, ভীতু রোগী পাকা চিকিৎসককে ভয় করে কেন, হাতুড়ে চিকিৎসকের জনসাধারণের মধ্যে আদরের কারণ, প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে জনসাধারণের বোধগম্য পদ্ধতিতে বহু পুস্তিকাও তিনি রচনা করেন। প্রায় প্রত্যেক রোগ সম্বন্ধেই তিনি ছোট ছোট বই লিখে গেছেন। বস্তি ও বৃদ্ধদেশে পাথুরী হয় কেন, এ সম্বন্ধে তাঁর একখানা মৌলিক তথ্যপূর্ণ রচনা আছে। শব্যবচ্ছেদ সম্বন্ধেও তিনি আলোচনা করেছিলেন । কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তি হচ্ছে বসন্ত ও হাম সম্বন্ধে ‘আল জুদারী ওয়াল-হাসবা’ নামক পুস্তকে বিস্তৃত ও বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা। এই গ্রন্থখানার লাটিন ও ইউরোপীয় সব ভাষাতেই তর্জমা করা হয়। এক ইংরেজি ভাষাতেই ১৪১৮ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় চল্লিশবার এই কিতাবখানার তর্জমা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। খ্রিস্টজগত মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজির মারফতেই এই দুটি কঠিন রোগ সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান লাভ করে। রোগ দুটির আক্রমণ ও লক্ষণ সম্বন্ধে তাঁর নিজের বর্ণনা থেকেই তাঁর সূক্ষ্ম জ্ঞানের সম্যক পরিচয় মেলে। বসন্তের উপসর্গ : বসন্ত আক্রমণের আগে বিরামহীন ভীষণ জ্বর হয়, পিঠে ব্যথা হয়, নাকে চুলকানিও ঘুমন্ত অবস্থায় শরীরে কাপুনি হয়। বসন্ত বের হলে এসব লক্ষণ  দেখা দেয়-জুরের সঙ্গে পিঠে ব্যথা, সারা শরীরে হুল ফুটানো ব্যথা, মুখের টানটান ভাব, চোখ ও গাল-দুটি ঘোর লাল, সারা শরীরে পেষণ ভাব ও গোশত এলিয়ে যাওয়া, গলায় ও বুকে বেদনা এবং শ্বাস ফেলতে ও কাশতে দারুণ কষ্ট, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, থুথু ঘন হওয়া, স্বর ভেঙে পড়া, মাথায় চাপ ও ব্যথা অনুভব করা, উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, বমি-বমি ভাব ও ছটফট করা। বসন্তের চেয়ে হাম হলে আরও বেশি উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, বমি-বমি ও ছটফট ভাব দেখা দেয়; আবার হামের চেয়ে বসন্তের আক্রমণে পিঠের ব্যথা আরও তীব্র হয়।

 

চিকিৎসা গ্রন্থ প্রণয়ন : ইরানে অবস্থানকালে মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি কিতাবুল মনসুরী নামে একখানি দশ-দফতরে সম্পূর্ণ বিরাট চিকিৎসা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন ও সিজিস্তানের শাসক মনসুর ইবনে ইসহাক আল-সামানীর নামে উৎসর্গ করেন। পনেরো শতকের অষ্টম পাদে মিলান শহরে এখানির একটি লাতিন তর্জমা প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তার ফারসি ও জার্মান সংস্করণও প্রকাশ করা হয়। ‘কিতাব আল-মুলুকী’ নামে আর একখানি চিকিৎসা গ্রন্থ তিনি তাবারিস্তানের শাসক আলি ইবনে ওয়েছ সুদানের নামে উৎসর্গ করেন।

 

আল-হাবী : মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে ‘আল-হাবী’ সর্বপ্রকার রোগ- সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনাসহ চিকিৎসার প্রণালি ও ঔষধের ব্যবস্থাসম্বলিত একখানি আভিধানিক গ্রন্থ। এই বিরাট গ্রন্থখানা কুড়ি দফতরে সমাপ্ত হয়, বর্তমানে তার মধ্যে মাত্র দশখণ্ডের অস্তিত্ব আছে। অ্যানজুবংশীয় (Anjou) সিসিলির রাজা প্রথম চার্লসের আদেশক্রমে ইহুদি চিকিৎসক ফারাজ ইবনে সলিম এই সুবৃহৎ গ্রন্থখানার লাতিন ভাষায়। তর্জমা করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ অবদান হিসাবে ‘আল-হাবী’ ইউরোপীয় চিন্তা- রাজ্যে অসামান্য প্রভাব  বিস্তার করেছিল। ১৪৮৬ সালের পর থেকে ইউরোপের প্রত্যেক দেশেই এই অনুবাদটি ক্রমাগত মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতে থাকে-১৫৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই বইটির পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। প্রত্যেক অংশের স্বতন্ত্র মুদ্রণ অজস্রভাবে হয়েছিল। ‘আল-হাবীর’ নবম খণ্ডটি ইউরোপের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ষোল শতক পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল। এই গ্রন্থখানায় আল-রাজী প্রত্যেক রোগসম্বদ্ধে প্রথমে গ্রিক, সিরীক, আরবি, ইরানি ও ভারতীয় চিকিৎসা প্রণালির বিস্তৃত বর্ণনা দান করেছেন, তারপর নিজের মতামত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিশদভাবে লিপিবন্ধ করেছেন। ‘আল-হাবী ও আল-জুন্দারী ওয়ালহাসবাহ’, চিকিৎসা বিজ্ঞানে আল-রাজীর অসামান্য জ্ঞানের জলন্ত স্বাক্ষর, এবং সর্বসম্মতিক্রমে তিনি সর্ব শ্রেষ্ঠ মুসলিম চিকিৎসাবিদ, এবং বিশ্বের সব যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের মধ্যে অন্যতম। পণ্ডিতদের মতে দার্শনিক ইবনে সিনা ও রুশদের পর আল-রাজী ব্যতীত অন্য কোনো মুসলিম মনীষাই মধ্যযুগীয় শিক্ষা ও রেনেসাঁয় এমন অসামান্য প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হননি।

 

পর্যবেক্ষণ শক্তি : মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজির পর্যবেক্ষণ শক্তি কত তীক্ষ্ণ ছিল এবং তিনি কতদূর সাবধানী চিকিৎসক ছিলেন, একটি দৃষ্টান্ত থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি যখন বাগদানে, সেই সময় বাগদাদের প্রধান হাসপাতালের জন্য স্থান নির্বাচনের ভার তাঁর উপর দেয়া হয়। তিনি প্রথমে কয়েক স্থানে কাঁচা গোশতের টুকরো ঝুলিয়ে রাখলেন। তারপর সেগুলোকে পরীক্ষা করে যেখানকার সবচেয়ে কম পচনশীল দেখা গেল, সেখানেই হাসপাতালের স্থান নির্দিষ্ট হলো।

 

মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা : মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজিই সর্বপ্রথমে ‘তিব্ব রুহানী’ বা ‘ইলাজ-নফসানী বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার কথা চিন্তা করেন এবং তার গ্রন্থাদিতে এ ধরনের চিকিৎসা- প্রণালির উপকারিতা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। মনোবিদ্যা (Psychology) সম্বন্ধে আল-রাজীর শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে ‘মানসিক শরীর’ (Spiritual Physic) নামক বিখ্যাত গ্রন্থখানা। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম এ গ্রন্থ খানির আরবি সংস্করণ প্রকাশিত হয়, এবং তার দ্বারাই একজন চমৎকার মনোবিদ ও শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসাবে আল- রাজীর প্রতিষ্ঠা হয়। মানব-চরিত্রের ওস্তাদী বিশ্লেষণে ও তার নৈতিক জীবন-গঠনের জ্ঞানগর্ভ ব্যবস্থাদানে গ্রন্থখানি অত্যন্ত উপাদেয়। আল-রাজী পারসী-সভ্যতার আবহাওয়ায় বর্ধিত, গ্রিক সভ্যতার উপযুক্ত উত্তরাধিকারী এবং আরবি সভ্যতার শিক্ষায় মানুষ। অতএব তাঁর এই গ্রন্থখানি প্রথম দুটি সভ্যতার অপূর্ব ও সুনিপুণ সংমিশ্রণ, যা তৃতীয়টির ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। বস্তুত এখানি বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যার (Metaphysics) এক উত্তম সংশ্লেষণ যা বিশ্বের এক শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদের মানসে রূপ পেয়েছে এবং একটা শ্রেষ্ঠ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। এ কথার সন্দেহের অবকাশ নেই যে, সমগ্র আরবিসাহিত্যে গ্রন্থখানি তুলনারহিত।

 

দার্শনিক আল-রাজি : মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি একজন উঁচুদরের দার্শনিকও ছিলেন। কিন্তু তাঁর দার্শনিক রচনাবলি বেশি প্রসার লাভ করেনি, এর কারণ হলো প্রায় সব মতাবলম্বী। মুসলিমই সেগুলোকে একবাক্যে ‘কুফরী’ বা ধর্মবিরোধী বলে নিন্দা করেছিল। এমন কি আবু রায়হান আল বিরুণীর মতো উদারমনা দার্শনিক বৈজ্ঞানিকও অন্য সবার সঙ্গে সমস্বরে প্রতিবাদ করেছিলেন। আল বিরুণী প্রথম জীবনে আল-রাজীর একজন প্রধান ভক্ত ছিলেন। তাঁর অধিবিদ্যাবিষয়ক গ্রন্থখানি (Metaphysics) বহুবার আগ্রহসহকারে তিনি পাঠ করেছিলেন। তিনি তাঁর একশ চুরাশিটি গ্রন্থের তালিকাও প্রস্তুত করেছিলেন। তিনিও রাজীকে মুক্ত চিন্তা নিয়ে অনধিকারচর্চা করার জন্য তীব্র আক্রমণ করেছেন; এমনকি বিদ্বেষবশে একথাও বলতে তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা মনীষীর বাধেনি যে, আল- রাজীর অন্ধতা ইলাহী-পজবের বা দৈব অভিশাপের ফল। রাজীর ‘নব্যুয়ত’ শীর্ষক গ্রন্থখানাই সবচেয়ে নিন্দালাভ করে। বর্তমানে এ গ্রন্থের কোনও অস্তিত্বই নেই। এই গ্রন্থটিতেই রাজী মন্তব্য করেন যে, যুক্তির (Reason) প্রাধান্য ‘ওহির’ (Revelation) বা প্রত্যাদেশের উপর। তাঁর এ মতবাদ কোনো মুসলিমই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আল- রাজী যে আল্লাহর সন্ধান তিনি যুক্তি ও বুদ্ধির পথেই ধরা দেন, তিনি সদানন্দ ও হাসামঙ্গলময়। রাজীর দার্শনিক চিন্তা-ভাবনায় এমন এক পুরুষের পরিচয় পাই, যাঁর মিথ্যা ভয় নেই, কারণ ভয়কে জয় করার মন্ত্র তাঁর কণ্ঠে বাজে; মিথ্যা আশা নেই, কারা তিনি জানেন যে, প্রকৃতি মঙ্গলময় কিন্তু ভালঙ্ঘনীয় তার বিধান। খ্যাতি সম্পদের মোহ নেই, কারণ এসবের অসারতায় তাঁর অটুট বিশ্বাস। তাঁর উপাদেয় উপদেশাবলিতে দুঃখ-শোকের লক্ষ ধারায় নিপীড়িত মানুষ সান্ত্বনা পায় ও লক্ষ্যপথের সন্ধান পায়। দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে আল-রাজি ছিলেন মধ্যযুগীয় ইসলামী জগতের একজন মৌলিক চিন্তাবিদ। তিনিও আল-কিন্দির মতো গ্রিক দর্শন দ্বারা হয়েছিলেন।

প্লেটো ছিলেন রাজির অধিবিদ্যা সংক্রান্ত মূল প্রেরণা বা উৎস। নৈতিক ধ্যান- ধারণার ক্ষেত্রেও তিনি সক্রেটিসের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থে আলোচিত আত্মবিষয়ক মতের রাজির ‘আধ্যাত্বিক দেহ’ (spiritual physic) শীর্ষক সুপরিচিত গ্রন্থের বিষয়বস্তুর বেশ মিল। রয়েছে। প্লেটোর সঙ্গীত ও ব্যায়াম সংক্রান্ত শিক্ষানীতিও আল-রাজি গ্রহণ করেন। তবে অ্যারিস্টটলের সঙ্গে রাজির মতের বেশ পার্থক্য হচ্ছে শূন্যদেশ (Void) এর সম্ভাব্যতাবিষয়ক। অ্যারিস্টটল দু’টি বস্তুর মধ্যবর্তী শূন্যদেশকে স্বীকার করেন। রাজি তা অস্বীকার করেন এবং প্লেটোর মতের অনুসরণে শূন্যদেশ সম্ভব বলে মনে করেন। গতিকে তিনি পদার্থের আবশ্যিক গুণ বলে মনে করেন। তাঁর মতে, গতি পদার্থের অন্তর্নিহিত একটি গুণ। অ্যারিস্টটলের মতে, তিনি মনে করেন না যে, গতি প্রকৃতির গুণ পদার্থের গুণ নয়।

 

গ্রিক পরমাণুবাদী দার্শনিক ডেমোক্রিটাসের মতের সঙ্গে তার মত সাদৃশ্যপূর্ণ। শুধু গতি ও শূন্য দেশকেই নয়, দেহ বা পদার্থের আনবিক গঠনকেও রাজি ডেমোক্রিটাসের মতের ব্যাখ্যা করেছেন। জড় কতগুলো অবিভাজ্য উপাদানে গঠিত। এগুলোকে পৃথকীকৃত করা যায় শুধু শূন্যদেশ দ্বারা। রাজির জড় পাঁচটি আদি সত্তার একটি। পাঁচটি আদি সত্তা হলো- জড়, দেশ, কাল, আত্মা ও স্রষ্টা। এই পাঁচটি আদি সত্তা হচ্ছে। রাজির অধিবিদ্যক চিন্তা-ধারার মূল ভিত্তি। রাজির মতে, সৃষ্টির মূলে রয়েছে জড় নামক পরমাণু। এই পরমাণু সৃষ্টির আদি উপকরণ। সৃষ্টির মূলে কেবল স্রষ্টাই থাকেন না, বরং একটি আদি জড় বা দ্রব্যের মাধ্যমে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন। শূন্য থেকে আকস্মিকভাবে জগত সৃষ্টির ধারণা অযৌক্তিক। যুক্তিসঙ্গত হবে যে স্রষ্টা জগত সৃষ্টি করেছেন এমন এক আকারবিহীন জড় থেকে যা অনাদিকাল থেকে অস্তিত্বশীল। রাজির মতে, দ্বিতীয় আদি সত্তা হচ্ছে দেশ (Space) যার মধ্যে জড় বিদ্যমান থাকতে পারে। দেশ বলতে রাজি এমন একটি বিমূর্ত ধারণাকে বুঝিয়েছেন, যা যৌক্তিকভাবে পদার্থ বা জড় থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এ প্রসঙ্গে, তিনি দু’রকমের দেশের কথা উল্লেখ করেছেন। সার্বিক দেশ জড় থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; বিশেষ দেশকে জড় থেকে পৃথক করে চিন্তা করা যায় না; কেননা জড়ই এর অন্তঃসার (Essence)।

 

মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজির কাল সম্পর্কিত ধারণাও অ্যারিস্টটলের মতের চেয়ে অনেকটা ভিন্নতর ।। অ্যারিস্টটলের মতে কাল গতির উপসৃষ্টি। এ মতানুযায়ী, কালের বাস্তবতা গতির ওপর নির্ভর করে কিন্তু মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি বলেন যে, “গতি কালকে সৃষ্টি করে না, বরং প্রকাশ বা প্রদর্শন করে মাত্র। এ প্রসঙ্গে, তিনি কালের বিশেষ ও সার্বিক রূপের মধ্যে।

 

আরো জানুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *