ইবনে খালদুন

ইবনে খালদুন

ইবনে খালদুন

ওয়ালীউদ্দীন আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রী.) মূলত একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্বখ্যাত। অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর অবদান নিয়ে। গবেষণাও বর্তমান যুগের একটি আকর্ষণীয় বিষয়। দীর্ঘকাল পর এখন তাঁকে। অনেকেই অর্থনৈতিক চিন্তার অন্যতম আদি পিতা হিসেবে স্বীকার করছেন।

ইবনে খালদুন এর সবচে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল মুকাদ্দিমা‘। এই বইতে তিনি

১. শ্রম বিভাজন,

২. মূল্য পদ্ধতি,

৩. উৎপাদন ও বণ্টন,

৪. মূলধন সংগঠন,

৫. চাহিদা ও যোগান,

৬. মুদ্রা,

৭. জনসংখ্যা,

৮. বাণিজ্যচক্র,

৯. সরকারী অর্থব্যবস্থা,

১০. উন্নয়নের স্তর এবং এমনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন।

শ্রমবিভাজন ও এর ইতিবাচক ফল সম্বন্ধে ইবনে খালদুন এর আলোচনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখিয়েছেন, একজন গম উৎপাদনকারীকে তার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ছয় থেকে দশ ধরনের সেবা নিতে হয়। এভাবে অন্যের সেবা নিয়ে নিজ প্রয়োজনের চেয়ে তিনি বেশি উৎপাদন করেন। উদ্বৃত্ত ফসলের বিনিময়ে তিনি অন্য দ্রব্য সংগ্রহ করেন। এভাবেই পরস্পর নির্ভরতার মধ্য দিয়ে প্রাচুর্য আসে। এই দিক দিয়ে ডেভিড রিকার্ডোর Comparative Advantage Theory-কে তার সমর্থক মনে হয় ।

ইবনে খালদুন বিভিন্ন পেশা সম্পর্কে এবং এসব পেশার সামাজিক উপযোগিতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। উৎপাদনের সামাজিক সংগঠনে মানবীয় শ্রমের গুরুত্ব তিনি তুলে ধরেছেন। মানবীয় শ্রমব্যবস্থা বর্তমানে একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয়।

দারিদ্র্যের ভিত্তি ও তার কারণ নিয়েও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। এসব কারণে কোন কোন চিন্তাবিদ তাঁকে প্রুধো, মার্কস, এঙ্গেলস প্রমুখের অগ্রবর্তী ও পূর্বসুরী মনে করেন।

ইবনে খালদুন এর মতে, জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জনসংখ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জনসংখ্যা বেশি হলে শ্রমবিভাজন ও বিশেষীকরণ সহজ হয়। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ফলে বিলাসদ্রব্যের চাহিদা বাড়ে ও শিল্পে বৈচিত্র্য আসে। তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ মডেলটি পরবর্তীতে অনেকে গ্রহণ করেছেন।

ইবনে খালদুন মনে করেন, প্রাকৃতিক সম্পদ নয়; বরং বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করেই শ্রমের আন্তর্জাতিক বিভাজন ঘটে। বোলাকিয়ার মতো আধুনিক অর্থবিজ্ঞানীগণ ইবনে খালদুনের এই ধারণার প্রশংসা করেছেন।

ইবনে খালদুন এর কিতাব আল-ইবার’ বিশ্ব ইতিহাস সম্পর্কে বিখ্যাত । গ্রন্থে তিনি রাজবংশের উত্থান-পতনের কার্যকারণ বিশ্লেষণ করেছেন। দারিদ্র্য ও এষের ধরন সম্পর্কেও তিনি অন্তর্ভেদী আলোকপাত করেছেন। তিনি ইসমূহের ধনী কিংবা দরিদ্র হওয়ার কারণ চিহ্নিত করারও চেষ্টা করেছেন।

 ইবনে খালদুন ধনী ও গরীব দেশগুলোর মধ্যে বিনিময়ের হার, আমদানি ফেতানির প্রবণতা, উন্নয়নের ওপর অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রভাব প্রভৃতি। বিশ্লেষণ করে বহু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এসকল তত্ত্বকে কেউ কেউ আধুনিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যতত্ত্বের আদিসূত্র মনে করেন।

ইবনে খালদুন সোনা ও রূপাকে যে অর্থে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন এবং তা ব্যবহারের কথা বলেছেন, তার সাথে পরবর্তী যুগের বাণিজ্যবাদীদের চিন্তার মিল দেখা যায়। এ কারণে তাকে বাণিজ্যবাদীদের পূর্বসূরী হিসেবেও গণ্য করা হয়।

শ্রমের মূল্যতত্ত্ব সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন। কারো কারো মতে ইবনে খালদুন এর শ্রমের মূল্যতত্ত্বে শ্রমিকের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ভূমিকা স্বীকৃত হয়েছে। কার্ল মার্কস অনেক পরে এসে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এ দিক থেকে তাঁকে মার্কসের পূর্বসূরী বিবেচনা করা যায়। সভেতলানা মনে করেন, অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ইবনে খালদুনই প্রথম মূল্যের রহস্য ভেদ করতে সক্ষম হন।

ইবনে খালদুন এর মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর নির্ভরশীল। ইতিহাস ব্যাখ্যায় অর্থনৈতিক বিষয়সমূহের ওপর তিনিই প্রথম গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রপথিক।

ইবনে খালদুন এর ‘সভ্যতার চক্রতত্ত্ব’-কে স্পেঙ্গলার তুলনা করেছেন জে আর হিকসের বাণিজ্য চক্রতত্ত্বের সাথে। কোন কোন আধুনিক অর্থনীতিবিদ ইবনে খালদুনকে কীনসের পূর্বসূরী মনে করেন। কীনসের বহু শতাব্দী আগে ইবনে খালদুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে ও ব্যবসায়ের মন্দা কাটিয়ে উঠতে সরকারী ব্যয়ের প্রয়োজন অনুভব করেন।

কর ও সরকারী ব্যয় সম্পর্কে ইবনে খালদুনের মত হলো, করের পরিমাণ কম হলে জনগণ সভ্যতার সুবিধাদি ভোগ করার সুযোগ পায়। ফলে তারা উৎসাহিতবোধ করে। এভাবে কম হারের কর সভ্যতার বিকাশে অবদান রাখে। কম হারের কর অর্থনৈতিক প্রাচুর্য আনতে ও করের ভিত্তি প্রসারে সহায়তা করে। ফলে সরকারের আয় বাড়ে। এর বিপরীতে করের উঁচু হার সরকারের আয় কমিয়ে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল রাখতে তাই সরকারী ব্যয় বাড়ানো এবং করের হার কমিয়ে রাখা প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত Progressive Taxation ধারণায় ইবনে খালদুনের করতত্ত্বের স্পষ্ট প্রভাব প্রতীয়মান হয় ।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইবনে খালদুন এর মৌলিক অবদানের প্রতি আধুনিক অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টি প্রথম আকর্ষণ করেন শ্যূমপীটার। সাম্প্রতিককালে ব্যারি গর্ডন তাঁর ‘ইকনোমিক অ্যানালিসিস বিফোর অ্যাডাম স্মীথ’ নামক গ্রন্থে ইবনে খালদুনের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণী ক্ষমতার কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। জে স্পেঙ্গলার, ফ্রাঞ্জ রোজেনথাল, টি বি আরভিং ও বোলাকিয়াসহ বহু ইউরোপীয় গবেষক ইবনে খালদুনের অন্তর্দৃষ্টি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার জন্য তাঁকে আধুনিক অর্থনীতির অন্যতম পুরোধা হিসেবে বিবেচনা করেন।

ইবনে খালদুনকে অর্থবিজ্ঞানের অন্যতম পিতা হিসেবে অভিহিত করে বোলাকিয়া লিখেছেন :

Ibn Khaldun discovered a great number of fundamental economic notions a few centuries before their official birth. He discovered the virtue and necessity of a division of labour before (Adam) Smith and the principle of labour value before (David) Ricardo. He elaborated a theory of population before Malthus and insisted on the role of the state in the economy before Keynes. But much more than that, Ibn used these concepts to build a coherent dynamic system in which the economic mechanism inexorably led economic activity to long-term fluctuations…. His name should figure among the fathers of economic science.

অর্থাৎ “অর্থবিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্বের প্রথাসিদ্ধ জন্মের কয়েক শতাব্দী আগে ইবনে খালদুন সেগুলো আবিষ্কার করেন। শ্রমবিভাজনের নীতিগত মান ও এর বাস্তব প্রয়োজন সম্পর্কিত ধারণা তিনি উপস্থাপন করেন (অ্যাডাম) স্মীথেরও আগে। (ডেভিড) রিকার্ডোর আগেই তিনি শ্রমের মূল্যতত্ত্ব আবিষ্কার করেন। জনসংখ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত তত্ত্বগত ধারণা উপস্থাপনে তিনি ম্যালথাসেরচাইতে অগ্রণী। কীনসের আগেই তিনি অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেছেন। তারচে বড় কথা, ইবনে খালদুন তাঁর এসব তত্ত্বের ভিত্তিতে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল ব্যবস্থার কাঠামো দাঁড় করান, যে ব্যবস্থার অর্থনৈতিক কর্মকৌশল তার অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে দীর্ঘমেয়াদী নমনীয়তার মধ্য দিয়ে অব্যাহতভাবে এগিয়ে নেয়। ইবনে খালদুনের নাম অর্থবিজ্ঞানের জনকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।”

 

আরো জানুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *