ইলম ও বিজ্ঞান

ইলম ও বিজ্ঞান

علم অর্থ জ্ঞান। এটি জাহল বা অজ্ঞতার বিপরীতার্থক শব্দ। ইলম একদিকে হিলম এবং অন্যদিকে মারিফা, ফিকহ, শুউর ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। আল-কুরআনে আলিমা ক্রিয়াপদটিকে সমাপিকা ও অসমাপিকা উভয় রূপেই ব্যবহার করা হয়েছে। এটি অনুজ্ঞা বা আদেশসূচক পদ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। তবে শব্দটিকে যখন সমাপিকা ও অনুজ্ঞারূপে ব্যবহার করা হয়েছে তখন শব্দটি জানার পরিবর্তে শিক্ষা লাভ করা অর্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। আবার علم এর আল্লামা রূপটি থেকে পরিশ্রম সাধ্য লেখাপড়ার ইঙ্গিত প্রদান করে, علم এর তখন এর লব্ধ ফল হিসেবে আবির্ভূত হয়।

ইলমের মতো عرف শব্দটির অর্থও জানা। তবে এ অর্থ সম্ভবত কিছু প্রাথমিক মুশতাক বা প্রত্যয়ান্ত শব্দ থেকে এসেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম চিন্তাবিদগণের মধ্যে মারিফা ও ইলম শব্দ দুটির তাৎপর্য সম্পর্কে মতভেদ দেখা দেয়। প্রথমটি দ্বারা চেতনা বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকে বোঝাত। এর দ্বারা জ্ঞান অর্জনের আগে একটি অজ্ঞতার অবস্থা যে ছিল তা ধরে নেয়া হতো। আর দ্বিতীয় শব্দটি দ্বারা সে জ্ঞানকে বোঝাত যাকে স্বতঃস্ফূর্ত বলে বর্ণনা করা যায়। অন্যকথায়, মারিফা দ্বারা বোঝায় সাধারণ জ্ঞান আর ইলম দ্বারা বোঝায় আল্লাহকে জানার জ্ঞান এবং সে অর্থে ধর্মবিষয়ক যে কোনো জ্ঞান। প্রকৃতপক্ষে এ পার্থক্যগুলো সম্পূর্ণ কৃত্রিম এবং সন্দেহযুক্ত। এমনকি উভয় শব্দের যথেষ্ট উদাহরণসহ অর্থগত আলোচনা করলেও এ সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। বিভিন্ন গবেষক নিজ নিজ পছন্দ অনুসারে এগুলোর ব্যবহার করেছেন। এভাবে প্রায়োগিক দিক থেকে অর্থের বিভিন্নতা ব্যাপকতর হয়েছে।

ইলম পরিভাষা দ্বারা মুতাকাল্লিমুনের পদ্ধতিগত ধারণার সব প্রয়োজনই মেটাতে হতো। তারা একে অ্যারিস্টটলীয়গণের চিন্তাপদ্ধতি বা জ্ঞানের সারবস্তুর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইলমকে তারা একটি অপ্রধান গুণ বা আপতন (আরাদ) হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুখতাস বিল হায়াত বা জীবন ও গঠন যা ইচ্ছা, শক্তি ইত্যাদির সমন্বয়ে নিম্নতর আকাঙ্ক্ষাহীন মনের কায়ফিয়াত বা অবস্থাসমূহের অন্যতম শ্রেণি ।

ইলম কাদীম বা চিরন্তন অথবা হাদীস বা সময় ও কালের মধ্যে উৎপন্ন কিনা তা নির্ণীত হয় এভাবে যে, স্থলম কি আল্লাহ তা’আলার মধ্যে বর্তমান নাকি সৃষ্ট কোনো সত্তাতে বিদ্যমান তার ওপর। কারণ এ দু’ধরনের ইলমের কোনো কোনো সাদৃশ্য নেই। মুতাকাল্লিমুন ইলম ও মারিফার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। তাঁরা ইলম দ্বারা যৌগিত ও বিশ্বজনীন কিছুকে বুঝিয়ে থাকেন আর মারিফা দ্বারা সহজ-সরল বস্তুকে ও বিশেষভাবে কোনো কিছুকে বুঝিয়ে থাকেন।

ধর্মতত্ত্ববিষয়ক দৃষ্টিকোণ থেকে ইলম ও আমল বা কাজ ও আচরণের সম্পর্কের মধ্যে আরো একটি পার্থক্য রয়েছে। বস্তুত একটি রয়েছে ইলম নাজারী যেমন কোনো বস্তু বিষয়ে জ্ঞান এবং কোনো ব্যক্তির এ জ্ঞান থাকলে তিনি সেখান থেকে বিরত হতে পারেন। আর একটি রয়েছে ইলম আমালী। যেমন- ইবাদত বা ধর্মীয় দায়িত্বসমূহ বিষয়ে জ্ঞান। ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করা হলে তবেই তা পরিপূর্ণ হলো। আল-কারাফী তাঁর তানকীহ গ্রন্থে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা কিছুটা ভিন্ন ধরনের যার বস্তুর জ্ঞান রয়েছে এবং সে জ্ঞানের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করে না সে অর্ধ-অনুগত আর যার জ্ঞান রয়েছে এবং সে অনুসারে কাজ করে তার কৃতিত্ব দ্বিগুণ।

আরো সাধারণ দৃষ্টিকোণ হতে দেখলে ইলমকে যদি ধর্মীয়রূপে প্রয়োগ করা হয় তখন তা মারিফার বিপরীত অর্থ প্রদান করে। যেমন মারিফা হতে পবিত্র নয় তেমন জ্ঞানেরও অংশ আবার আদাবের সঙ্গেও বৈপরীত্য প্রকাশ পায় এভাবে যে, এর প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা কঠিন। তবে আদাব দ্বারা বিশেষ করে সাহিত্যবিষয়ক ও পেশাগত প্রশিক্ষণই অধিক বুঝিয়ে থাকে যা অনেকটা মারিফার অনুরূপ। দীর্ঘদিন আলিম শীর্ষক ইসমে ফাইল বা কর্তবাচক বিশেষ্য পদটি দ্বারা ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে বোঝাত। পরবর্তীতে যে কোনো জ্ঞানী ব্যক্তিকে বোঝানোর জন্য শব্দটির সাধারণ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। অথচ জ্ঞানী, পণ্ডিত বা বিদ্বান বোঝানোর জন্য হাকীম শব্দের ব্যবহারও প্রচলিত ছিল। একইভাবে প্রথমদিকে ইলমের ব্যবহারে সংকীর্ণ গণ্ডি থাকলেও চূড়ান্তভাবে শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে সব ধরনের জ্ঞানকে বোঝানো হতে থাকে।

এটি যথার্থ যে, তালাবুল ইলম কথাটির মধ্যে ইলম বলতে অধিকাংশের মতে, হাদীসকে বোঝানো হয়েছে। কারণ হাদীস শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনের জন্যই দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হতো বা তা অন্বেষণে আত্মনিয়োগ আবশ্যক ছিল। কিন্তু হযরত রাসূল (স.) অসংখ্য হাদীসে 1 মুসলমানদেরকে যে ইলম বা জ্ঞান অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন সেখানে তিনি ধর্মীয় জ্ঞানই বোঝাতে চেয়েছেন এমন কথা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। তাই যে সর হাদীসে ইলম শব্দটি রয়েছে সেখানে জ্ঞান অর্থ বোঝায় সঙ্গত। ইসলামের প্রথম শতাব্দীর বিভিন্ন পাঠে একে শিক্ষালাভ অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রথম বিস্তারিত চর্চা করেন দার্শনিকগণ, এরপর বিভিন্ন ধারার চিন্তাবিদ ও লেখকগণ। আল-গাযালি (র.) তাঁর ইহইয়াউল উলুমিদ্দীন গ্রন্থে ইলমের ব্যবহারের এ বৈচিত্র্য তালিকাভুক্ত করেন। হিজরি ৩য় / খ্রিস্টীয় ৯ম শতক হতে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইলম শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। Introduction a lo theologic Musulmane গ্রন্থে S. M. M. Anawati ইলম পরিভাষা ব্যবহারের একটি প্রায় পরিপূর্ণ তালিকা উদ্ধৃত করেছেন। এ গ্রন্থে জ্ঞানের গঠনরীতিতে কালামের স্থান বিবেচনা করে আল-ফারাবী, ইখওয়ানুস সাফা, আল-খাওয়ারিযমী, ইবনুন নাদীম, আল- গাযালি ও ইবনে খালদুনের শ্রেণিবিভাগ দেখানো হয়েছে। এর সঙ্গে ইবনে সিনার যুরজী যায়দানের তালিকাও উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকা প্রণেতাদের নামের সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে ইবনে কুতাইবা, আৰু হাইয়ান তাওহীদী, ইবনে হাযম, মিসকাওয়ায়হ প্রমুখের নাম। এসব তালিকা পরীক্ষা করলে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করা যায় যে, আরব ইসলামী বিজ্ঞান ও অনারব বিজ্ঞান উল্লেখের ক্ষেত্রে শুরুর দিকে অনারব বিজ্ঞানের আধিপত্য ছিল। কিন্তু সময় যত অতিক্রান্ত হয়েছে ততই অনারব বিজ্ঞানের পরিমাণ কমেছে, বৃদ্ধি পেয়েছে আরব ইসলামী বিজ্ঞান। ক্রমাগতভাবে এ ধারা অব্যাহত থেকেছে। আল-গাযালি (র.) এ ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেন। তিনি মাহমুদা বা প্রশংসনীয় এবং মাযমুমা বা নিন্দনীয় বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। তিনি মাযমুমা বা নিন্দনীয় বিজ্ঞানের মধ্যে অপ্রয়োজনীয়। বিবেচিত হয় এমন সব শাখাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, দুনিয়াতে জীবনের জন্য ক্ষতিকর এবং আখিরাতে আত্মার কল্যাণের পক্ষে ক্ষতিকর বিষয়সমূহও এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

তবে সাধারণভাবে যে মনোভাব তা কিছুসংখ্যক মুসলিমকে প্রাচীন ঐতিহ্য গ্রহণ ও উপস্থাপনা হতে বিরত রাখতে পারেনি। এ বিজ্ঞানের সঙ্গে তাঁরা নিজেদের অবদানও রেখে গেছেন। ফলে আল-জাবর ওয়াল মুকাবালা ও ইলমুল হিসাব বা গণিতশাস্ত্র, ইলমুল হিয়াল বা কারিগরি বিদ্যা, আসতুরলাব, ফালাক বা ইলমুল হায়আ বা জ্যোতির্বিদ্যা, ইলমুত তিব্ব বা চিকিৎসাবিদ্যা, ইলমুন নাবাতাত বা উদ্ভিদবিদ্যা, কীমিয়া বা রসায়ন, ইলমুল হায়ওয়ান বা প্রাণিবিদ্যা ইত্যাদি অসংখ্য জ্ঞানের শাখা বিস্তার লাভ করেছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে, জ্ঞানের নতুন শ্রেণিবিন্যাসে যা বিজ্ঞান নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তা ইলম ছাড়া অন্য কিছু নয়।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *