আল কুরআনের গুরুত্ব

আল কুরআনের গুরুত্ব

আল কুরআনের গুরুত্ব: মানব জীবনে আল-কুরআনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সীমাহীন। আল্লাহ তা’আলা এ মহাগ্রন্থ মানুষের জীবন-যাপনের সংবিধান হিসেবে নাযিল করেছেন। এর মধ্যে তিনি মানুষের সফলতার নির্দেশনা দিয়েছেন। তাদের ব্যর্থতার কারণ বলে দিয়েছেন। সব ক্ষেত্রে কী তাদের করণীয় এবং কী করা উচিত নয়- তারও বিবরণ দিয়েছেন। ফলে আল-কুরআন পরিণত হয়েছে মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতার অব্যর্থ নির্দেশনা হিসেবে।

আল কুরআনের গুরুত্ব

১. সঠিক পথের দিশা : আল-কুরআন হলো সঠিক পথের দিশা। এর পঠন ও অনুসরণ মানুষকে সীরাতুল মুস্তাকীমের পথে পরিচালিত করে। সে চির সত্য, শাশ্বত সুন্দর পথে পরিচালিত হতে পারে। কাজেই জীবন পথের প্রকৃত নির্দেশনা হিসেবে কুরআন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাগ্রন্থ।

২. পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান : মানব জীবনের সব সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান গ্রন্থ হিসেবে আল-কুরআন বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। এ গ্রন্থটি আগত, অনাগত সব মানুষের জন্য আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

وَنَزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَبَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ

“আমি আপনার ওপর কিতাব নাযিল করেছি। তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, সুপথের নির্দেশনা, রহমত এবং মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ। “

– (আল-কুরআন, ১৬: ৮৯) – প্রকৃতই আল-কুরআনে আছে মানব জীবনের সব দিক ও বিভাগের নির্দেশনা। জীবনের এমন কোনো প্রসঙ্গ নেই, মানব জীবনের এমন একটি দিক ও বিভাগ নেই যে বিষয়ে কুরআন নীতি পেশ করেনি।

৩. ত্রুটিহীন গ্রন্থ : আল-কুরআন নির্ভুল হিদায়াতের স্মারক তাই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের প্রথম ও প্রধান অলৌকিকতা হলো এ গ্রন্থ নিজের সংশয়, সন্দেহ ও ত্রুটিহীনতার ঘোষণা দিয়েছে। সাধারণভাবে লেখা বইয়ের শুরুতেই মুদ্রণ বা অন্যান্য তথ্যজনিত ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়। পরবর্তীতে দোষ-ত্রুটি দূর করার জন্য সহৃদয় পাঠকের সহযোগিতা চাওয়া হয়। কিন্তু কুরআন ভাষণের শুরুতেই সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে

ذلك الكتبُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ

* এটি সেই কিতাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য এটি পথনির্দেশ।” [আল-কুরআন, ২ : ২]

৪. মর্যাদাপূর্ণ গ্রন্থ : মর্যাদাগত কারণেও আল-কুরআন অপরিসীম। গুরুত্বের দাবিদার 1 আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাবসমূহের মধ্যে মর্যাদায় কুরআনই সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

لَوْ أَنْزَلْنَا هَذَا الْقُرْآنَ عَلَى جَبَلٍ لَرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ

“এ কুরআন যদি আমি পর্বতের ওপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে তা আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হয়ে যেত।” [আল-কুরআন, ৫৯: ২১] তিনি আরো বলেন :

إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ فِي كِتَبٍ مَّكْنُونٍ لَّا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُوْنَ

“নিশ্চয় এটি সম্মানিত কুরআন, যা আছে সুরক্ষিত কিতাবে। যারা পূত-পবিত্র

তারা ছাড়া অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না।” [আল-কুরআন, ৫৬:৭৭-৭৯]

৫. শাশ্বত সত্য : শাশ্বত সত্যের ভাষ্যকার হিসেবেও কুরআনের গুরুত্ব রয়েছে। আল- কুরআন সর্বজনীন ও সর্বকালীন এক চিরন্তন সত্য মহাগ্রন্থ। এ গ্রন্থের সংশয়হীনতা ও অভ্রান্ত নির্দেশনা এতটাই সুনিশ্চিত ও অকাট্য যে তা সব কালের ও সব দেশের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ তা’আলা এর সত্যতা খণ্ডনের সর্বাত্মক চ্যালেঞ্জ

ঘোষণা করে বলেছেন, وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَ لَمْ مِينَ

دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَدِقِينَ

“তোমাদের যদি কোনো সন্দেহ হয় যা আমি আমার বান্দার ওপর নাযিল করেছি তা সম্পর্কে, তাহলে তার মতো একটি সূরা রচনা কর এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সাক্ষীদের ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” [আল-কুরআন, ২: ২৩ কিন্তু কুরআন নাযিল পরবর্তী দেড় হাজার বছর পরও এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো কোনো সংশয়বাদীকে পাওয়া যায়নি। এ থেকে কুরআন মাজীদের শাশ্বত সত্য হওয়ার বিষয়টি অবিসংবাদিতভাবে প্রমাণিত হয়। অবশ্য কুরআন মাজীদের বিষয় এবং বর্ণনা বিন্যাসও এর সত্যতাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। কেননা কোনো মানুষের পক্ষে এমন বিষয় বিন্যাসে বিস্তারিত বিধান পেশ করা সম্ভব নয়।

৬. নির্ভুল ভবিষ্যৎ বক্তা : কুরআন মাজীদ ভবিষ্যতের অজানা, অদৃশ্য অসংখ্য ঘটনা ও বিষয় সম্পর্কে নির্ভুল বিবরণ পেশ করেছে। মুসলিমদের মক্কা বিজয়, রোম বিজয়, হযরত রাসূলুল্লাহ (স.)-এর বিরুদ্ধে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে কুরআন শতভাগ নিখুঁত ও অকাট্য ভবিষ্যদ্বাণী করে নিজের অলৌকিকত্বকে অবিসংবাদিত করে তুলেছে।

৭. ইতিহাস গ্রন্থ: একটি নির্ভুল ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে কুরআনের রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। মানব জাতি এবং বিশ্বজাহানের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ হলো আল-কুরআন। আদ, সামুদ প্রভৃতি জাতি বা নমরুদ, ফিরআউন, কারুণ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা ধ্বংস করে দিয়েছেন, যাদের সম্পর্কে লিখিত বা প্রামাণ্য কোনো যথার্থ তথ্য অবশিষ্ট নেই, কুরআন মাজীদ তাদের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

هَلْ أَنكَ حَدِيثُ الْجُنُودِ فِرْعَوْنَ وَثَمُودَ

“সেনাবাহিনীর ইতিবৃত্ত আপনার কাছে পৌঁছেছে কি? ফিরআউন ও সামুদের?”

– [আল-কুরআন, ৮৫ : ১৭-১৮] কুরআনে মানুষের উৎপত্তি, পৃথিবীতে আগমন, তাদের বিকাশ, মানুষের হিদায়াতের জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রেরিত নবী-রাসূলদের জীবন, ধর্মপ্রচার, বাধা-বিঘ্ন ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির নিখুঁত বিবরণ এসেছে। রাসূলুল্লাহ (স.)-এর জীবনাচার ও সমকালীন পৃথিবীর সর্বাধিক বিশ্বাস্য দলিল কুরআন মাজীদ। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ اَحْسَنَ الْقَصَصِ بِمَا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ هَذَا الْقُرْآنَ وَإِنْ كُنْتَ مِنْ قَبْلِهِ

لمِنَ الْغُفِلِينَ
“আমি আপনার কাছে উত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছি। সে জন্য আমি আপনার কাছে এ কুরআন নাযিল করেছি। এর আগে এ ব্যাপারে আপনি অবশ্যই অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।” [আল-কুরআন, ১২ : ৩]

৮. সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য:  সাহিত্য সমালোচনার যে কোনো বিচারে আল-কুরআন হলো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য। এ গ্রন্থখানা সম্পূর্ণ পদ্য কিংবা পুরোপুরি গদ্যরীতিতে রচিত কোনো গ্রন্থ নয়। বরং এ দুয়ের সংমিশ্রণে প্রণীত এক অভূতপূর্ব গ্রন্থ। শব্দচয়ন, উপমা নির্বাচন, শিল্পমান, ছন্দমূর্ছনা, রচনাশৈলী, অভিনব গ্রন্থনা, প্রাঞ্জল ভাষা, বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব কুরআনকে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যে পরিণত করেছে। কুরআনকে অলঙ্কারশাস্ত্রের এক বিশ্বকোষ বলা যায়। বাণী বিন্যাস, হৃদয়গ্রাহী দৃষ্টান্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শপথ কুরআনের সাহিত্যমানকে অকল্পনীয় উচ্চতায় সমাসীন করেছে। কুরআন ছাড়া আর কোনো গ্রন্থে এমন বিষয় বৈচিত্র্য দেখা যায় না। ‘কম শব্দ বেশি বক্তব্য’ নীতিতে মাত্র ৬২৩৬ খানা আয়াতে আল-কুরআনে যেভাবে মানব জীবনের সব সমস্যার সমাধান পেশ করা হয়েছে, সাহিত্যিক উৎকর্ষতা বিচারে তার দ্বিতীয় কোনো নজির পাওয়া যায় না। বস্তুত এ জন্যই সমকালীন আরবের সব কবি-সাহিত্যিক স্বীকার করে নিয়েছিলেন, কুরআন মানুষের রচিত গ্রন্থ হওয়া সম্ভব নয়।

৯. জ্ঞানের মূল উৎস : আল-কুরআন সব ধরনের জ্ঞানের মূল উৎস। সব রকমের জাগতিক, বৈষয়িক ও ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূলনীতি, সূত্র এবং প্রেরণা এ মহাগ্রন্থে বিবৃত হয়েছে। এ মহাগ্রন্থে ব্যাকরণ, আইন, আধ্যাত্মিকতা, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থ, রসায়ন, দর্শন, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সাহিত্য, তর্কশাস্ত্র, অলঙ্কারশাস্ত্র, ফারাইয, নসিহত, বর্ষপঞ্জিসহ জীবনঘনিষ্ঠ সব প্রয়োজনীয় জ্ঞানের মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- চিকিৎসা বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা

বলেন, وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا

“আমি অবতীর্ণ করি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু তা জালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।” [আল-কুরআন, ১৭ : 821 মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে রয়েছে,

وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍ لَهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ وَالْقَمَرَ قَدَّرْتُهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُوْنِ الْقَدِيمِ لَا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ

النَّهَارِ وَكُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

“সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণে। চাঁদের জন্য আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মনযিল; অবশেষে তা শুকনো, থাকা, পুরনো খেজুর শাখার আকার ধারণ করে। সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া এবং রাতের পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে।” [আল-কুরআন, ৩৬ : ৩৮-৪০ ) এ জন্য কুরআন মাজীদকে আল্লাহ তা’আলা আল-হিকমা বা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা’ এবং আল-হাকীম বা জ্ঞানগর্ভ, বিজ্ঞানময় গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

ذلِكَ مِمَّا أَوْحَى إِلَيْكَ رَبُّكَ مِنَ الْحِكْمَةِ

“আপনার প্রতিপালক ওহী দ্বারা আপনাকে যে হিকমত দান করেছেন এগুলো তার

অন্তর্ভুক্ত।” [আল-কুরআন, ১৭ : ৩৯/ এছাড়াও আল্লাহ এ মহাগ্রন্থখানাকে আল-হাকীম বা জ্ঞানগর্ভ, বিজ্ঞানময় গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

১০. গবেষণা ও আবিষ্কারের প্রেরণা: কুরআন মাজীদ গবেষক ও বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও আবিষ্কারের চিরকালীন প্রেরণা হয়ে আছে। এ মহাগ্রন্থ নাযিলকালীন সময় থেকেই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্যে সক্রিয় উদ্দীপক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। বিজ্ঞানী, গবেষক এবং জ্ঞানবান মানুষকে গবেষণা করার আদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছে। গবেষণা ও আবিষ্কারকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ হিসেবে অভিহিত করেছে। যেমন- ফ্রিজের ধারণাটি পাওয়া যায় উটের পানি জমা করে রাখা পদ্ধতির মধ্যে। আল্লাহ তা’আলা এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন,

افَلَا يَنْظُرُونَ إِلَى الْإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ

“তবে কি তারা দৃষ্টিপাত করে না উটের দিকে, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?”

[আল-কুরআন, ৮৮ : ১৭ প্রকৃত যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের সব সময় গবেষণার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ

“অতএব হে চক্ষুষ্মান লোকেরা! তোমরা গবেষণা কর। [আল-কুরআন, ৫৯ : ২] গবেষণা ও আবিষ্কারের কাজকে আনুষ্ঠানিক ইবাদতের চেয়ে বেশি মর্যাদার এ বিষয়টি কুরআন নানাভাবে বিশেষণ করার প্রয়াস পেয়েছে। বারবার মানুষকে আকাশের নির্মাণশৈলী, তার নিজের সৃষ্টিতত্ত্ব, প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক সৃষ্টিকৌশল প্রভৃতি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এসব বিষয় থেকে শিক্ষা গ্রহণের এবং বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করার নির্দেশনা দিয়েছে। কুরআন মাজীদ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো গবেষণা গ্রন্থ বা ধর্মগ্রন্থে এমন নির্দেশনা পাওয়া যায় না।

১১. অতীত গ্রন্থসমূহের সার-সংক্ষেপ : কুরআন মাজীদের বিশেষত্ব হলো এ মহাগ্রন্থখানি অতীত কিতাবসমূহের সার-সংক্ষেপ। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। মুহাম্মদ (স.)-এর ওপর নাযিলকৃত কুরআন মাজীদই মানুষের জন্য আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কালাম। এতে কেবল পরবর্তী মানুষের জন্য নির্দেশনাই বিবৃত হয়নি বরং পূববর্তী সব কিতাবের মূল শিক্ষাও বর্ণনা করা হয়েছে। এ হলো অতীত গ্রন্থসমূহের নিখুঁত ও নির্ভুল নির্যাস। আল্লাহ বলেন, 1

الله اللهُ لا إلهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ نَزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ التَّوْرَة وَالْإِنْجِيلَ مِن قَبْلُ هُدًى لِلنَّاسِ وَانْزَلَ الْفُرْقَانَ إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَأَنْزَلَ

بِأَيْتِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَاللَّهُ عَزِيزٌ ذُو انْتِقَامٍ “আলিফ লাম মীম, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক। তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যা তার আগের কিতাবের সমর্থক। আর তিনি অবতীর্ণ করেছেন তাওরাত ও ইনজীল । ইতোপূর্বে মানুষকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য; আর তিনি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন। যারা আল্লাহর নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের জন্য কঠোর শাস্তি আছে। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, দণ্ডদাতা।” [আল-কুরআন, ৩: ১-৪]

১২. ব্যক্তিক গুরুত্ব : ব্যক্তি বৃহত্তর মানব সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ জন্য কুরআন প্রথমেই ব্যক্তিকে কুফর, শিরক, পৌত্তলিকতা প্রভৃতি অসার বিশ্বাস বর্জন করে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণের আহ্বান জানিয়েছে। কুরআন ব্যক্তিকে সাধারণ সংসারী, ধার্মিক এবং কর্মমুখর হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। মুমিনদেরকে সালাতের সমান গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার আদেশ দিয়ে কর্মহীন থাকার সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সংসার ত্যাগ করা বা বৈরাগ্য জীবন-যাপন করাকে সম্পূর্ণ মানুষ সৃষ্ট বিষয় আখ্যায়িত করে এ ব্যাপারে সর্বোতভাবে নিরুৎসাহ সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে আল-কুরআনের নির্দেশনায় মানুষ কর্মমুখী, সংসারী, ধার্মিক এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্তিগত জীবন-যাপন করতে পারে। যা তাকে যে কোনো সমস্যা থেকে দূরে রাখার জন্য যথেষ্ট এবং যথোপযুক্ত।

১৩. পারিবারিক গুরুত্ব : মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি, স্বামী, স্ত্রী, ভাই, বোন প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে মুসলিম পরিবার গড়ে ওঠে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসা, সহানুভূতি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি এবং সর্বাত্মক সহযোগী মনোভাব প্রতিষ্ঠার জন্য কুরআন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কুরআন বিভিন্নভাবে নিকটাত্মীয়দের নানা রকমের হক নির্ধারণ করে দিয়ে তা আদায়ের পথ নির্দেশ করেছে এবং এর মাধ্যমে পারিবারিক অবকাঠামো, শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণ নিশ্চিত করেছে। এখানে পরিবারের প্রতিজন সদস্যকে অন্যের ওপর দায়িত্বশীল বিবেচনা করা হয়েছে। কাজেই পারিবারিক জীবনে আল- কুরআনের বিপুল গুরুত্ব অনুমিত হয়।

১৪. সামাজিক গুরুত্ব: মানুষ সামাজিক জীব। আত্মীয়-অনাত্মীয়, মুসলিম-অমুসলিম, পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে তাকে সামাজিক জীবন- যাপন করতে হয়। অবিচার, জুলুম, অধিকার আত্মসাৎ, হত্যা, চুরি-ডাকাতি ছিনতাই, ব্যভিচারিতা ও নানা রকম খারাপ আচরণ সামাজিক জীবনকে দুর্বিধ করে তোলে। এ অবস্থা নিরসনে কুরআন ন্যায়বিচার, সদাচার ও প্রয়োজনীয় দণ্ডবিধানের ঘোষণা দিয়েছে। সহানুভূতি, সদাচার ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে মাজীদ মানুষের সামাজিক জীবনকে সমস্যামুক্ত ও শান্তিপূর্ণ করার সামগ্রিক বিধান দিয়েছে। কুরআন

১৫. জাতীয় গুরুত্ব : জাতীয় জীবনের মূল সমস্যা হলো অনৈক্য, পারস্পরিক আস্থাহীনতা এবং জাতীয় দায়িত্ব পালনে অবহেলা প্রদর্শন। এ সমস্যার মূলোৎপাটন করতে মুসলিম জাতিকে কুরআনে ঐক্যবদ্ধ ও আস্থাশীল থাকার এবং প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا

“তোমরা আল্লাহর পথ ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না।”

– [আল-কুরআন, ৩: 100] এ ঘোষণার মাধ্যমে আল-কুরআন বিভক্তি, অনৈক্য, দায়িত্বহীনতা প্রভৃতি জাতীয় সমস্যার সর্বাধিক কল্যাণকর সমাধান দিয়েছে। এর আলোকে কাজ করলে জাতীয় জীবনে আর কোনো সমস্যাই থাকতে পারবে না।

১৬. আন্তর্জাতিক গুরুত্ব : বর্ণ ও অঞ্চলগত সঙ্ঘাত, সাম্রাজ্য বিস্তারের অশুভ বাসনা, জবর-দখল, যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস প্রভৃতি বিশ্ব পরিস্থিতিকে অশান্ত করে রাখে। কুরআন বিশ্বের সব কালের ও সব দেশের মানুষদের একই বংশোদ্ভূত ঘোষণা দিয়ে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে বর্ণ ও অঞ্চলগত সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছে। শান্তি বজায় রাখতে কুরআন শান্তিচুক্তি বা সন্ধির নির্দেশনা দিয়েছে। এমনকি মুসলিম জাতি বা রাষ্ট্রকে সাহায্য করার ক্ষেত্রেও চুক্তির মর্যাদা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। কাজেই কুরআনের ঘোষণা মেনে নিলে পৃথিবীর সব মানুষ শান্তি ও স্বস্তিতে বসবাস করতে পারবে। অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ বা অন্যায় রক্তপাত পৃথিবীর সবুজ প্রান্তরকে রঞ্জিত করবে না। বরং প্রতিজন মানুষ, প্রতিটি রাষ্ট্র অপর ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর থাকবে।

১৭. ধর্মীয় গুরুত্ব : ধর্ম নিয়ে সঙ্ঘাত, রক্তপাত ও বাড়াবাড়ি বিভিন্ন ধর্মানুসারী মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে রেখেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মানুষের জীবন অশান্তিপূর্ণ করে তুলেছে। এর সমাধানকল্পে কুরআন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে-

لا إكراه في الدِّينِ

“দীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।” [আল-কুরআন, ২: ২৫৬]

কাজেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে আল-কুরআন অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে।

১৮. রাজনৈতিক গুরুত্ব : এক আল্লাহর পরিবর্তে অসংখ্য মানুষ প্রভু’র প্রভুত্ব মানুষের রাজনৈতিক জীবনের মূল সমস্যা। এ সমস্যা নিরসনে কুরআন ঘোষণা করেছে,

قُلِ اللهُمَّ مُلِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ

“বল হে আল্লাহ! আপনি সার্বভৌম শক্তির মালিক। আপনি যাকে খুশি তাকে রাজত্ব দান করেন।” [আল-কুরআন, ৩: ২৬]

মানুষের প্রভুত্বের অবসান ঘটাতে আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন, “সাবধান! সৃষ্টি তাঁর, আইন রচনার অধিকারও তাঁরই।” তাছাড়া পদ প্রার্থিতা, আত্মপ্রচার, ক্ষমতা ও পদের লোভ, স্বেচ্ছাচারিতা, দম্ভ, প্রকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুপস্থিতিও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। মানুষের জন্য অকল্যাণকর বিবেচিত হওয়ায় আল-কুরআন এর সবকিছুকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

কুরআনী রাজনীতিতে তাই ব্যক্তি বা দল পূজা থাকে না। এখানে মানুষ স্বাধীন রাজনৈতিক জীব হিসেবে তার নিজের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। কেউ তাকে বাধ্য করতে পারে না, বরং সে যেন স্বাধীনভাবে তার বক্তব্য পেশ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্যই কুরআনী রাজনীতির চর্চা করা অনিবার্য।

১৯. রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব : শাসকদের উদাসীনতা ও দুঃশাসন, নাগরিকদের অবাধ্যতা এবং দায়িত্বহীনতা এবং শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্কহীনতাই রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত করে। এ সমস্যা নিরসনে শাসকদের জন্য কুরআনের নির্দেশনা হলো,

وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ

“কাজে-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ কর।” [আল-কুরআন, ৩ : ১৫৯] আল-কুরআন রাষ্ট্রকে শাসকবর্গের হাতের ক্রীড়নক কোনো প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করে না। বরং এটি হলো মানুষের সুখ ও শাস্তির নিশ্চয়তা দাতা, তাদের জীবন-সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা দাতা প্রতিষ্ঠান। কাজেই তা কারো স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হবে না। রাষ্ট্র হবে জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণের অতন্দ্রপ্রহরী।

২০. অর্থনৈতিক গুরুত্ব : সম্পদের অসম বণ্টন, উপার্জন ও ব্যয়ে হারাম পদ্ধতি অনুসরণ, সম্পদ আত্মসাৎ, সুদ, ঘুষ প্রভৃতি হচ্ছে মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা। কুরআন এ সমস্যা সমাধানে শ্রমনির্ভর ও যাকাতভিত্তিক এবং সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা চালু করার নির্দেশনা দিয়েছে। অসম অর্থবণ্টন রোধে আল্লাহ তা’আলা যাকাত প্রথার প্রবর্তন করেছেন। এ ব্যবস্থায় ধনীর সম্পদে গরিবের বিধিসম্মত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আল-কুরআনে এসেছে,

وَأَقِيمُوا الصَّلوةَ وَآتُوا الزَّكوة

“তোমরা সালাত কায়িম কর ও যাকাত দাও।” [আল-কুরআন, ২:৪৩]

অর্থব্যবস্থাকে শোষণমুক্ত রাখতে সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرَّبُوا

“আল্লাহ তা’আলা বেচা-কেনা হালাল করেছেন, সুদ হারাম করেছেন।”

-[আল-কুরআন, ২: 295 ] কুরআন সব রকমের আর্থিক অনাচারকে হারাম ঘোষণা করে। জুয়া, ঘুষ, অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদকে ব্যক্তির চিরকালীন শাস্তি ভোগের কারণ হিসেবে বর্ণনা করে কুরআন অর্থব্যবস্থাকে পবিত্র ও শোভন রাখার ব্যবস্থা করেছে। এভাবে বিস্তারিত বিধান প্রবর্তন করে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে কুরআন মাজীদ অনবদ্য

গুরুত্ব পালন করে।

২১. শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব : নীতি ও আদর্শহীন শিক্ষা এবং অশালীন সংস্কৃতির চর্চা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের মূল সমস্যা। তাছাড়া অশিক্ষা ও নিরক্ষরতা মানুষকে কুসংস্কারপূর্ণ অন্ধকার জীবনে ঠেলে দেয়। এ সমস্যা সমাধানে কুরআন সবার জন্য শিক্ষাগ্রহণ ফরয করেছে এবং নিষিদ্ধ করেছে সব অশালীন আচরণ। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

إِقْرَا بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

“পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।” [আল-কুরআন, ৯৬ : ১] অশোভন সংস্কৃতির চর্চা নিষিদ্ধ করে আল্লাহ বলেছেন, “বল, সুনিশ্চিতভাবেই আমার প্রভু সব অশালীনতা ও অশীলতা হারাম করেছেন। ” সঠিক শিক্ষা গ্রহণ এবং সুস্থ সংস্কৃতির চর্চাকে কুরআন মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকাশের শ্রেষ্ঠতম বাহন হিসেবে বর্ণনা করেছে। কুরআন নির্দেশিত পন্থায় মানুষ যদি শিক্ষা গ্রহণ করে তাহলে শিক্ষিত লোকেরা জ্ঞান পাপী হয়ে দেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করবে না এবং তারা নৈতিক পবিত্রতা ধ্বংসকারী কোনো প্রথা ও পদ্ধতিও প্রবর্তন করবে না।

২২. সামরিক গুরুত্ব : সামরিক জীবনের মূল সমস্যা হলো অন্যায় আক্রমণ ও সীমা লঙ্ঘন করা যুদ্ধ । যুদ্ধ শেষে নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন এ সমস্যাকে আরো অমানবিক করে তোলে। আল-কুরআন এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে। অসামরিক লোক যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না, নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং বিকলাঙ্গদের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, তাদেরকে হত্যা করা, সাধারণ লোকদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, ফল ও ফসলের মাঠ নষ্ট করা, অকারণে গাছ কেটে ফেলা, আত্মসমর্পণ করা শত্রুসেনার সঙ্গে খারাপ আচরণ করা ইত্যাদিকে আল-কুরআনে সীমালঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করে এসব কাজ থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বস্তুত এ নির্দেশ পালন করা হলে পৃথিবীতে অন্যায় আগ্রাসনের কোনো ঘটনা আর কখনোই ঘটবে না।

২৩. নৈতিক গুরুত্ব : নৈতিক অধঃপতন এমন এক সমস্যা যা মানব জাতির ধ্বংস ডেকে আনে। এ সমস্যা থেকে মুক্তি লাভের জন্য কুরআন মানুষকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। মানুষকে নৈতিক স্খলন ও নীতিহীনতা থেকে রক্ষার জন্য কুরআনে সব রকমের পাপাচার, বিদ্রূপ, উপনামে ডাকা, দোষারোপ, দোষান্বেষণ, ভিত্তিহীন অনুমান, গীবত, অন্যায় ও অশালীন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আল-কুরআন নৈতিক উৎকর্ষতাকে মানুষের মর্যাদা ও

অবস্থান ধরে রাখার মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ ثُمَّ رَدَدْتُهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ

“আমি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছি। এরপর আমি তাকে স্থীনতাগ্রস্তদের হীনতমে পরিণত করি।” [আল-কুরআন, ৯৫ : ৪-৫] কাজেই কুরআনী নির্দেশনার আলোকে মানুষ যদি তার চরিত্র গঠন করে তাহলে এমনিতেই পৃথিবীতে কোনো অন্যায় থাকতে পারে না। কেননা প্রতিজন মানুষ যদি কুরআনের নৈতিক বিধান মেনে অন্যায় থেকে বিরত থাকেন তাহলে অন্যায় সৃষ্টি হওয়ার কোনো উপায়ই থাকবে না। এ জন্য কুরআনের বিপ্লব ও শিক্ষাকে একটি সম্পূর্ণ নৈতিক শিক্ষা ও বিপ্লব বলা যায়।

২৪. আধ্যাত্মিক গুরুত্ব : আল-কুরআন মানুষের দুটি সত্তার কথা উল্লেখ করেছে। একটি দেহ, অন্যটি রূহ বা আত্মা। পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া এবং সত্যিকারের সাফল্য লাভের জন্য মানুষকে তাই দৈহিক ইবাদত করা ও পবিত্রতা অর্জনের পাশাপাশি রূহের ইবাদত সম্পাদন এবং পবিত্রতাও অর্জন করতে হয়। সে কারণে কুরআন আধ্যাত্মিক বা আত্মিক সমস্যা নিরসনেও যথার্থ উদ্যোগ নিয়েছে। মানুষের দৃশ্যমান কাজ যে গ্রহণযোগ্য কোনো কাজ নয় বরং তার জন্য যে আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা সবচেয়ে বড় বিষয় কুরআন বিভিন্নভাবে সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছে। আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা ছাড়া ইবাদত করলে তা যে বরং আরো ক্ষতির কারণ হতে পারে। কুরআন সে সম্পর্কেও মানুষকে হুঁশিয়ার করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ الَّذِينَ هُمْ يُرَآؤُونَ

“সুতরাং দুর্ভোগ সে সব সালাত আদায়কারীদের জন্য যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে।” [আল-কুরআন, ১০৭:৪-৬] কাজেই কুরআনী নির্দেশনার আলোকে মানুষ যদি তার আত্মাকে পবিত্র করে, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিশুদ্ধ করে কাজ সম্পাদন করে তাহলে সে এ ক্ষেত্রের সব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারে।

২৫. পার্থিব গুরুত্ব : কুরআনে পার্থিব জীবনকে উপেক্ষা করতে বলা হয়নি। কেননা পার্থিব জীবনের কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করেই পরকালীন সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ধারিত হবে। যেমন নবী (স.) বলেছেন ‘দুনিয়া আখিরাতের শস্য ক্ষেত্র।’ সে জন্য কুরআন মানুষকে পার্থিব ও পরকালীন দু’জীবনেই সাফল্য ও কল্যাণ লাভের প্রার্থনা শিখিয়েছে। কাজেই কুরআন এটা বলে না যে, পৃথিবীর জীবনকে বর্জন কর। বরং কুরআন বলে, পৃথিবীর জীবন থেকে তোমার প্রয়োজনীয় অংশগ্রহ করতে ভুলে যেয়ো না।’

২৬. পরকালীন গুরুত: পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী। এ জীবন নশ্বর। পার্থিব জীবনাবসানের পর মানুষ পরকালের অনন্ত জীবনে প্রবেশ করে। এ জীবনের সাফল্যই আসল সফলতা। এ জীবনে ব্যর্থ হওয়া মানেই চিরস্থায়ী ধ্বংসে পতিত হওয়া। এজন্য আল-কুরআন পরকালীন জীবনকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশনা দেয়। বস্তুত আল্লাহর কাছে পরকালমুখী চেষ্টা, সাধনাই গ্রহণযোগ্য। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

وَمَنْ أَرَادَ الْأَخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَّشْكُورًا

“যারা পরকাল কামনা করে এবং মুমিন অবস্থায় তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে, এমন লোকদের চেষ্টাই স্বীকৃত হয়ে থাকে।” [আল-কুরআন, ১৭ : ১৯] কুরআন ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো গ্রন্থ মানুষের আখিরাতের জীবন সম্পর্কে এমন সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও বিস্তারিত বিবরণ পেশ করে না। কাজেই আখিরাতে মুক্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে কুরআনের নির্দেশনা অনুসরণের বিকল্প নেই। কাজেই মানব জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রত্যেকটি কাজে সফলতা ও কল্যাণ লাভের মাধ্যম হিসেবে আল-কুরআনের অপরিসীম গুরুত্ব প্রতীয়মান হয় ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *